করোনাকালে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াবে এই দাওয়াই
করোনাভাইরাসে সৃষ্ট মহামারি চলছে।এই মারণ ভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়াই করতে এখনো কোনো প্রতিষেধক আসেনি। তাই রক্ষাকবচ হিসেবে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানো জরুরী। এই করোনাকালে আয়ুর্বেদিক পদ্ধতির দাওয়াই শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরিতে ভূমিকা রাখতে পারে।
রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধিতে সাড়ে পাঁচ হাজার বছরের পুরনো আয়ুর্বেদিক পন্থা নিরুপায়ের উপায় করে দিতে পারে।
আয়ুর্বেদে রয়েছে তিনটি চর্যাপদ্ধতি। এর মধ্যে দৈনন্দিন জীবনধারার নিয়মকে বলা হয় ‘দিনচর্যা’। যেমন সূর্যোদয়ের আগে বিছানা ত্যাগ, শৌচকর্ম সারা, দন্তধাবন (নিম, বকুল, বাবুল, করঞ্জ, খয়ের ইত্যাদির নরম ডাল দিয়ে দাঁত মাজা), নস্য (নারকেল তেল বা তিল তেল দুই ফোঁটা নাকে দেওয়া), কবল/কুলকুচি (তিল তেল, ত্রিফলা ক্বাথ ইত্যাদির দ্বারা), সারা শরীরে খাঁটি তেল দিয়ে মালিশ করা, ব্যায়াম করা, স্নান ও পরিষ্কার বস্ত্রধারণ।
অন্যদিকে রাত্রিকালীন জীবনধারার নিয়মকে বলা হয় ‘রাত্রিচর্যা’। যেমন সূর্যাস্তের পর খাদ্যগ্রহণ, আহারের পর একশো কদম পায়ে হাঁটা, পায়ের পাতায় তেলমালিশ ইত্যাদি।
আর সর্বশেষ ঋতুভিত্তিক জীবনধারার নিয়মকে বলা হয় ‘ঋতুচর্যা’। এই তিন জীবনধারা আমাদের নীরোগ রাখে ও রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়িয়ে দেয়।
>>আয়ুর্বেদের দৈনন্দিন আহারবিধিকেও গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। তামানির্মিত জলের জগ, গ্লাস, পাত্র তার ক্ষমতাবলে জীবাণুকে নাশ করে। এই ক্ষমতাকে বলে ‘অলিগোডাইনামিক এফেক্ট’।
>>ত্রিফলা, হলুদ ইত্যাদি সংযোগে কুলকুচি করতে বলা হয়েছে। ত্রিফলা, হলুদ ও মধু মিশিয়ে ব্যবহার করলে মুখের প্রাক ক্যানসার অবস্থা বা ওরাল সাব মিউকসাল ফাইব্রোসিসের ক্ষেত্রে সাফল্য পাওয়া যায়। আবার শুধু ত্রিফলা ব্যবহার করেও ওরাল সাব মিউকসাল ফাইব্রোসিসের সাফল্য আসে।
আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানের মতো আয়ুর্বেদেও রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বা ইমউনিটিকে তিন ভাগে করা হয়েছে। যাকে ‘বল’ বা ‘ব্যাধি ক্ষমত্ব’ বলে।
সহজবল : প্রাকৃতিক বা ন্যাচারাল, যেটা মানুষ জন্মসূত্রে পায়।
কালজবল : এই বল বা ইমউনিটি নির্ভর করে সময়, ঋতু বা বয়স অনুসারে।
যুক্তিকৃতবল : যে বল বা ইমউনিটি মানুষ জীবনকালে অর্জন করে, যাকে আমরা ‘অ্যাকোয়ার্ড ইমউনিটি’ বলি। ভ্যাকসিন বা টিকা এই গোত্রের মধ্যে পরে।
এছাড়াও আয়ুর্বেদে এক ধরনের চিকিৎসাপদ্ধতি আছে, যাকে ‘রসায়ন চিকিৎসা’ বলে। তা এই যুক্তিকৃত বলকে বাড়াতে সাহায্য করে। রসায়ন চিকিৎসাকে আয়ুর্বেদ এতই প্রাধান্য দিয়েছে যে আয়ুর্বেদের প্রধান আটটি অঙ্গের মধ্যে এই রসায়ন চিকিৎসা (জেরিয়াট্রিক মেডিসিন)ঠাঁই পেয়েছে।
আয়ুর্বেদে প্রচুর পথ্য আর ভেষজের উল্লেখ আছে যা এই রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে বৃদ্ধি করে। সাড়ে পাঁচ হাজার বছর আগেই যে গাছগুলো বা পথ্যগুলো বলা হয়েছে, আজকের দিনে আধুনিক বিজ্ঞান সেই ভেষজকে সিলমোহর দিচ্ছে।
ত্রিফলা : আমলকি, হরীতকী ও বহেড়া— এই তিনটি ফল একত্রে বলা হয় ‘ত্রিফলা’। আমলকির উপকারিতার জন্য এই ফলকে আয়ুর্বেদে ‘অমৃতফল’ বলে। আর হরীতকীকে আয়ুর্বেদে ‘মাতা’ বলা হয়েছে।
হরীতকী, বহেড়ার মধ্যে আছে চেবুলাজিক আ্যসিড, গালিক আ্যসিড, অ্যালাজিক আ্যসিড ইত্যাদি। যা শরীরের ক্ষতিকারক প্রদাহ সৃষ্টিকারী ফ্রি র্যাডিক্যালসকে নষ্ট করে দেয়। হরীতকী ইনফ্লুয়েঞ্জা ‘এ’ভাইরাসের উপর কার্যকরী।
গ্রাম পজিটিভ ব্যাক্টিরিয়ার ওপর বহেড়া খুবই ভালো কাজ করে। প্রদাহের স্থানে শ্বেত রক্তকণিকা যেমন নিউট্রোফিল, মাক্রোফাজ ইত্যাদিদের সঞ্চালনের কাজকে প্রশস্ত করে।
আমলকীর অ্যান্টি অক্সিড্যান্ট ক্ষমতার জন্য যে চার যৌগ দায়ী, তারা এমব্লিকানিন এ, এমব্লিকানিন বি, পুনিগ্লুকোনিন ও পেডুনক্লাজিন। এই চারটি ট্যানিন জাতীয় উদ্ভিজ যৌগ।
ত্রিফলার ‘প্রোকাইনেটিক’গুণ আছে যার জন্য প্রাকৃতিক উপায়ে কোষ্ঠকাঠিন্য দূর হয়।রোজ রাতে এক চামচ ত্রিফলা চূর্ণ গরম জলের সঙ্গে পান করলে শরীরের প্রভূত উপকার হয়।
গুলঞ্চ : গুলঞ্চ হলো অতি পরিচিত লতানে গাছ। শরীরের শ্বেত রক্তকণিকারা শরীরে কোনও জীবাণু ঢুকলে আক্ষরিক অর্থে তাকে গিলে নেয়। এই পদ্ধতিকে বলে ‘ফ্যাগোসাইটোসিস’। গুলঞ্চ এই গোসাইটোসিস পদ্ধতির হারকে বাড়িয়ে তোলে এবং সিরাম অ্যান্টিবডির পরিমাণকে বাড়িয়ে তোলে। এটি জ্বরের পশমকারী পথ্য হিসেবে ব্যবহার হয়। গুলঞ্চর কাড়া বা ক্বাথ বানিয়ে পান করলে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ে। বুকের ক্রনিক সংক্রমণও সারে।
তুলসি : এই গাছ বহুল পরিচিত। তুলসিতে আছে ওলেয়ানলিক আ্যসিড ও আরসলিক আ্যসিড।এটি প্রদাহনাশক এবং নানা ভাইরাস— যেমন রোটা ভাইরাস, হেপাটাইটিস সি ভাইরাস ইত্যাদির উপর বিশেষ ভাবে কার্যকরী। তাছাড়া ভাইরালজনিত জ্বরেও এটি খুবই উপকারী।
হলুদ : হলুদের অপরিসীম গুণ। আমাদের দৈনন্দিন খাবারে তার উপস্থিতিই প্রমাণ করে তা শরীরে জন্য কতটা গুরুত্বপূর্ণ। হলুদে উপস্থিত যৌগ কারকুমিন জিকা ও চিকুনগুনিয়া ভাইরাসকে দমন করতে সাহায্য করে।
এছাড়াও ইনফ্লুয়েঞ্জা ও হেপাটাইটিস ভাইরাসের উপর হলুদ সমান কার্যকরী। সকালবেলায় খালি পেটে ৫ গ্রাম হলুদ গুড় সহযোগে খেলে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ে, শরীরের প্রদাহ নাশ হয়, ত্বকের জেল্লা বাড়ে ও হেলিকোব্যাক্টর পাইলোরি ব্যাক্টিরিয়ার হানায় পেটে হওয়া আলসারেও উপকার পাওয়া যায়।
কালোমরিচ : কালো মরিচে আছে পাইপেরিন। একে আধুনিক বিজ্ঞানীরা মনে করেন, ‘বায়োঅ্যাভেলিবিলিটি এনহানসার’। খাবারে একটু কালো মরিচ যুক্ত করলে স্বাদের সঙ্গে গুণও বাড়ে। এছাড়াও শুকনো কাশিতে মরিচের গুঁড়ো আর তালমিছরি চেটে খেলে অনেকটা আরাম পাওয়া যায়।
অশ্বগন্ধা : অশ্বগন্ধায় আছে উইথানোলাইড। অশ্বগন্ধা নার্ভের টনিক হিসেবে কাজ করে এবং বিষণ্ণতা, টেনশন, মানসিক চাপে খুবই ভাল কাজ করে। নার্ভের অসুখ ও অনিদ্রা থাকলে রোজ রাতে গরম দুধের সঙ্গে এক চামচ অশ্বগন্ধা সেবন করলে উপকার পাওয়া যায়।
মনোক্কা : সুস্বাদু মনোক্কাতে আছে ভরপুর আয়রন। তবে কিশমিশের মতো এটি বীজহীন আর স্বাদে আম্লিক নয়। এর ত্বকে ও বীজে আছে অতি গুরুত্বপূর্ণ যৌগ রেসভেরাট্রল যা জীবাণুনাশক ও ক্যানসারের ক্ষেত্রে খুবই কার্যকরী। এটি রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানোর অতি উত্তম ভেষজ। এছাড়া রোজ রাতে দুই থেকে তিনটে মনোক্কা জলে ভিজিয়ে পরের দিন খেলে শিশুদের কোষ্ঠকাঠিন্য দূর হয়।