করোনা ও লকডাউনের সময় ভাবী মায়েরা কী করবেন?
করোনার প্রকোপ বাড়ছে৷ বাড়ছে লকডাউন৷ ফলে নিয়মিত চেকআপ ও পরীক্ষা-নিরীক্ষায় ভাটা পড়েছে গর্ভবতী মায়েদের৷ টেনশন বাড়ছে প্রবল৷ হঠাৎ সমস্যা হলে কোথায় যাবেন, গাড়ি-ঘোড়া পাওয়া যাবে কি না, হাসপাতাল ভর্তি নেবে কি না বা নিলেও সেখান থেকে যদি সংক্রমণ হয়! তার উপর সুযোগ বুঝে বড় হাসপাতাল-নার্সিংহোম রেট বাড়িয়েছে দ্বিগুণের বেশি৷ পিপিই লাগবে, করোনার পরীক্ষা হবে ইত্যাদি প্রভৃতি কারণে৷ ছোট নার্সিংহোম হয় বন্ধ নয়তো নাম-কে-ওয়াস্তে খোলা৷ সেখানে ভর্তি হওয়ার সুযোগ নেই বললেই চলে৷ সরকারি হাসপাতালে রোজই করোনার খবর৷ তো সাধারণ মানুষ যাবেন কোথায়!
এরই মাঝে কানে আসছে দু’-চারটি করে ভাল খবরও৷ গর্ভবতী মজুর রমণীকে হাসপাতালে পৌঁছে দিচ্ছেন পুলিশ আধিকারিক৷ খাবার দিচ্ছেন তাঁর পরিজনকে৷ ডাক্তার-নার্স পরিষেবা দিচ্ছেন দ্বিগুণ যত্নে৷ আসন্ন-প্রসবাকে নিজের গাড়িতে নার্সিংহোমে নিয়ে আসছেন চিকিৎসক৷ বিনামূল্যে অপারেশন করে নজির গড়ছেন মানবিকতার৷
কিন্তু এ সব হল ব্যতিক্রমী ঘটনা৷ ধূ ধূ মরুভূমিতে দু-একটা মরুদ্যান৷ বাকিদের হাল তো যথেষ্টই বেহাল৷ বেশি টেনশন করলে নিজের ও ভাবী সন্তানের ক্ষতি হতে পারে জেনেও দু-চোখের পাতা এক করতে পারছেন না তাঁরা৷ ভেবে পাচ্ছেন না, কোন পথে আসবে মুক্তি?
চেম্বারে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে হবে। ছবি: শাটারস্টক।
মুক্তির পথ
“অত টেনশনের কিন্তু কিছু নেই৷” জানালেন স্ত্রীরোগ ও বন্ধ্যাত্ব বিশেষজ্ঞ সুদীপ বসু৷ “চিকিৎসকেরা সবাই মোটামুটি ভিডিয়ো কলে যোগাযোগ রেখে চলেছেন৷ কাউন্সেলিং করা হচ্ছে৷ রক্তচাপ, সুগার, ওজন দেখতে বলা হচ্ছে বাড়িতেই৷ রুটিনমাফিক সোনোগ্রাফি না হলেও প্রয়োজন হলে করিয়ে নেওয়া হচ্ছে৷ প্রয়োজনে হচ্ছে রক্তপরীক্ষাও৷ মূল কথা হল, সামনাসামনি বসে ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলতে না পারলেও ভাবী মায়েদের অসুবিধে হচ্ছে না কোনও৷ বরং চেম্বারে আসতে হচ্ছে না বলে সংক্রমণের আশঙ্কা কমে যাচ্ছে অনেক৷’’ সুদীপবাবুর বক্তব্য, চেম্বারে এক জন গর্ভবতীর সঙ্গে এক জন কি দু-জন বাড়ির লোক আসেন৷ ফলে ঘড়ি ধরে সময় দিলেও এক এক সময় ৯-১০ জনের ভিড় লেগে যায়৷ তার উপর কর্মচারী, ডাক্তার, নার্স মিলে আরও ৪-৫ জন৷ ফলে যে কোনও সময় চেম্বারে ১২-১৪ জনের ভিড়৷ এ রকম পরিস্থিতিতে সবার সঙ্গে ৬ ফুট দূরত্ব বজায় রাখা কি সম্ভব? কাজেই আপাতত ভিডিয়ো কলের মাধ্যমে রোগী দেখাই নিরাপদ।
কিন্তু যাঁর স্মার্ট ফোন নেই? গ্রামগঞ্জের সাধারণ মানুষজন? স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ শঙ্করনাথ মিত্র জানিয়েছেন, “কোনওমতে সরকারি হাসপাতালে পৌঁছে যেতে পারলেই আর চিন্তা নেই৷ সেখানে সব পরিষেবা আছে৷ অনেকে বাইক বা স্কুটিতেও চলে আসছেন৷ কেউ আসছেন হেঁটে বা গাড়ি ভাড়া করে৷ প্রত্যন্ত গ্রামে আশা সেন্টারগুলি ভাল কাজ করছে৷ ভাবী মায়েদের পুষ্টির দিকে খেয়াল রাখা, স্বাস্থ্যবিধি বোঝানো, রক্তচাপ-সুগার-হিমোগ্লোবিন মাপা, টিটেনাস ইনজেকশন দেওয়া, সব করছেন তাঁরা৷ খুব প্রয়োজন হলে কাছাকাছি স্বাস্থ্যকেন্দ্রে পাঠাচ্ছেন৷ সেখানে সোনোগ্রাফি হচ্ছে৷ তা ছাড়া সম্ভাব্য প্রসবের দু’-চার দিন আগে ভর্তি হলে কোভিড পরীক্ষাও করিয়ে নেওয়া হচ্ছে৷ কাজেই অত টেনশন করার কিছু নেই৷”
ভাবী মায়ের কোভিড হলে!
“ভাবী মায়েদের কোভিডের আশঙ্কা বেশি বলে একটা সময় ভাবা হয়েছিল বটে৷ কিন্তু পরে দেখা যায় ধারণাটা ঠিক নয়৷ কোনও অজ্ঞাত কারণে গর্ভাবস্থায় কোভিডের আশঙ্কা খুব একটা বাড়ে না৷ তা-ও যদি হয়, কোভিড হাসপাতালে পাঠিয়ে দিতে হবে৷ প্রসব হবে সেখানে৷” বললেন শঙ্করনাথবাবু৷
চিকিৎসক বসু জানিয়েছেন, “এখনও পর্যন্ত যতটুকু জানা গিয়েছে, তার ভিত্তিতে বলা যায় গর্ভবতী মায়েদের রোগ হলেও তা বেশির ভাগ ক্ষেত্রে মৃদু বা বড়জোর মাঝারি পর্যায়ে থাকে৷ ভাবী সন্তানেরও কোনও ক্ষতি হয় না বলে জানা গিয়েছে বিভিন্ন গবেষণায়৷ কাজেই টেনশনের কিছু নেই৷”
গবেষণার ফল
• ১১৮ জন কোভিড গর্ভবতীর উপর সমীক্ষা চালিয়ে উহানের চিকিৎসক বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন, এঁদের মধ্যে ৯২ শতাংশের রোগ ছিল মৃদু পর্যায়ের৷ ২১ শতাংশের প্রসব হয়েছিল সময়ের আগে৷ আমেরিকাতে হওয়া এক গবেষণা থেকে অবশ্য জানা গিয়েছে, প্রায় ৫০ শতাংশ ক্ষেত্রে সময়ের আগে প্রসব হতে পারে৷ সার্স ও মার্সের মহামারির সময়েও এ রকমই হয়েছিল বলে জানা যায়৷
• গর্ভাবস্থার প্রথম তিন মাসের মধ্যে সংক্রমণ হলে সার্স ও মার্সের ক্ষেত্রে গর্ভপাতের আশঙ্কা ছিল প্রায় ৪০ শতাংশ৷ কোভিডে কিন্তু সে বিপদের খবর পাওয়া গিয়েছে মাত্র একটি৷ সুইৎজারল্যান্ডের লুসেন ইউনিভার্সিটি হাসপাতালের তরফে চিকিৎসক ডেভিড বড জানিয়েছেন তাঁর এক রোগীর ১৯ সপ্তাহে গর্ভপাত হয়েছে৷ জার্নাল অব আমেরিকান মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনকে পাঠানো এক চিঠিতে তিনি জানান, সম্ভবত মায়ের প্ল্যাসেন্টা থেকে রোগ ছড়িয়েছে ভ্রূণে৷ কারণ প্রায় ২৪ ঘণ্টা পর্যন্ত প্ল্যাসেন্টাতে ভাইরাস জীবিত ছিল৷ তবে আরও অনেক গবেষণা না করে এ ব্যাপারে কোনও সিদ্ধান্তে পৌঁছনো যাবে না বলে তিনি মনে করেন৷
• ইরানের ৭টি বড় হাসপাতালে ভর্তি গর্ভবতী কোভিড রোগীদের উপর সমীক্ষা চালিয়ে ‘আমেরিকান জার্নাল অব অবস্ট্রেটিক্স ও গাইনোকলোজি’তে প্রকাশিত প্রবন্ধে বিজ্ঞানীরা ৭ জনের মৃত্যুর খবর জানিয়েছেন৷ চিনে গর্ভবতী কোভিড রোগীদের মধ্যে মারা গিয়েছেন কেবল এক জন৷ অথচ ২০০২ সালে সার্সে যেখানে সাধারণ মৃত্যুহার ছিল ১০.৫ শতাংশ, গর্ভবতীদের মধ্যে ছিল প্রায় ২৫ শতাংশ৷ এমনকি, সোয়াইন ফ্লুতে মোট মৃতের তালিকার ৫ শতাংশই ছিলেন গর্ভবতীরা৷ কোভিডের ক্ষেত্রে এ রকম ট্রেন্ড এখনও দেখা যাচ্ছে না৷
স্বাভাবিক ভাবে প্রসব হলেও চিকিৎসক, চিকিৎসাকর্মী সবাইকে পিপিই পরে নিতে হবে। ছবি: শাটারস্টক।
কোভিড রোগীর প্রসব
“অনেকের ধারণা, স্বাভাবিক পথে প্রসব করালে মা থেকে সন্তানে রোগ ছড়াতে পারে৷ কিন্তু ধারণাটা ভুল৷” জানালেন সুদীপ বসু৷ তাঁর মতে, “যাঁর যে ভাবে প্রসবের প্রয়োজন, তাঁকে সে ভাবেই করাতে হবে৷”
শঙ্করনাথ মিত্র জানিয়েছেন, “সিজারে বরং বিপদ তুলনায় বেশি, তবে সেটা সন্তানের নয়, চিকিৎসক ও চিকিৎসাকর্মীদের৷ কাজেই নির্দিষ্ট গাইডলাইন মেনে সিজার করতে হয়৷”
কোভিড রোগীর সিজারের নিয়ম
• চিকিৎসক, চিকিৎসাকর্মী সবাইকে পিপিই পরে নিতে হবে, সেটা অবশ্য স্বাভাবিক পথে প্রসব করালেও পরতে হবে৷
• পুরো অজ্ঞান করলে শ্বাসনালীতে যে টিউব পরাতে হয়, সেখান থেকে রোগ ছড়ানোর আশঙ্কা বেশি৷ কাজেই শিরদাঁড়ায় ইনজেকশন দিয়ে অবশ করে অপারেশন করতে হয়৷
• পেট কাটার সময় সচরাচর ডায়াথার্মি নামে এক বিদ্যুতচালিত কাটারের সাহায্য নেওয়া হয়, তাতে যে অ্যারোসল বা তরলের সূক্ষ্ম কণা বাতাসে ছড়িয়ে পড়ে তা থেকে একটু হলেও সংক্রমণের আশঙ্কা থাকে৷ কাজেই ডায়াথার্মি যথাসম্ভব কম ব্যবহার করতে বলা হয়৷
রোগ কি মা থেকে সন্তানে ছড়াতে পারে?
“প্ল্যাসেন্টা দিয়ে ছড়ানোর আশঙ্কা আছে কি না তা নিয়ে এখনও নিশ্চিত প্রমাণ পাওয়া যায়নি৷ ছোট ছোট দু-একটা স্টাডি হয়েছে, তাতে দু’-এক জনের ক্ষেত্রে ছড়িয়েছে দেখা গিয়েছে৷ আবার ছড়ায়নি এমন নজিরও আছে৷” জানালেন চিকিৎসক মিত্র৷
তা হলে কোভিড মায়ের সন্তান কী ভাবে সংক্রামিত হচ্ছে? “হচ্ছে, স্বাস্থ্যবিধি ঠিক ভাবে না মানার ফলে৷ হাত পরিষ্কার করে ধুয়ে মাস্ক পরে বাচ্চাকে বুকের দুধ খাওয়ানোর কথা, বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশ সে রকমই৷ সেখানে কোনও ভুলচুক হলে সমস্যা হতে পারে৷ সে ক্ষেত্রে সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন-এর নির্দেশমতো বুকের দুধ বোতলে ভরে খাওয়াতে হবে৷ সব নিয়ম মেনে নার্সের সাহায্যে মা দুধ বার করে দেবেন, তা খাওয়াবেন অন্য কেউ৷ বুকের দুধ দিয়ে রোগ ছড়ায় না, চিন্তা নেই৷” জানালেন চিকিৎসক সুদীপ বসু৷
চিকিৎসক শঙ্করনাথ মিত্র জানিয়েছেন, “আমাদের দেশে স্বাস্থ্যসচেতনতা যথেষ্ট কম৷ কাজেই মায়ের কোভিড ধরা পড়লে সন্তানকে আলাদা করে রাখাই ভাল৷ হয়ও তাই৷ মাকে পাঠানো হয় আইসোলেশনে৷ সন্তান থাকে নার্সারিতে৷ তবে কোভিডের ভয়ে এত জড়োসড়ো থাকার কোনও প্রয়োজন নেই৷ গর্ভাবস্থায় সামান্য কয়েকটি নিয়ম মেনে চললেই কিন্তু রোগের আশঙ্কা অনেক কম থাকে৷”
ভাবী মায়ের সাবধানতা
আর পাঁচজনে যা করেন, আপনাকেও তাই করতে হবে৷ তবে একটু বেশি সতর্কতার সঙ্গে৷ যেমন—
• ঘন ঘন হাত ধোওয়া৷ বাড়িতে লোকজন বেশি থাকলে ঘণ্টায় ঘণ্টায় ধুয়ে নেওয়াই ভাল৷
• বাড়িতে কারও হাঁচি-কাশি-জ্বর হলে তাঁর থেকে কম করে ৬ ফুট দূরে থাকা৷ সম্ভব হলে মাস্ক পরে থাকা৷
• বাইরের কারও সঙ্গে মেলামেশা না করা৷
• নিতান্ত প্রয়োজন না হলে ডাক্তারের চেম্বারেও যাওয়ার দরকার নেই৷ গেলে যথাযথ সাবধানতা নিয়ে যাওয়া ও ফিরে এসে জামা-জুতো-ব্যাগ থেকে শুরু করে সব কিছু ধুয়ে স্নান করে নেওয়া৷