জরায়ুমুখ ক্যান্সারের ভ্যাকসিন সংকট
ঢাকায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইরোলজি বিভাগের ভ্যাকসিন সেন্টারে নারীদের জরায়ুমুখে ক্যান্সারের ভ্যাকসিন দেওয়া হতো। কিন্তু বিগত ৬ মাস ধরে ভ্যাকসিন দেওয়া পুরো বন্ধ রয়েছে। আমদানি না হওয়ায় বন্ধ রয়েছে ভ্যাকসিন দেওয়ার কার্যক্রম।
এই ভ্যাকসিনের অভাবে ভবিষ্যতে নারী স্বাস্থ্য মারাত্মক হুমকির মুখে পড়তে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইরোলজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. মুনিরা জাহান বলেন, ‘জিএসকে থেকে সম্পন্নরূপে ভ্যাকসিন সরবরাহ বন্ধ রয়েছে। ফলে তাদের থেকে জরায়ুমুখে ক্যান্সারের ভ্যাকসিন সার্ভিসও বন্ধ রয়েছে। আর আমাদের নিজস্ব ভ্যাকসিনের কোনো কোম্পানি নেই। যার কারণে আপাতত ভ্যাকসিন দেওয়া বন্ধ রয়েছে। শুধু আমাদের এখানে না, সম্ভবত কোথাও এই ভ্যাকসিন দিতে পারছে না।’
নারীদের জন্য এটা কোনো ক্ষতি বয়ে আনছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘ভ্যাকসিন হচ্ছে রোগ প্রতিরোধের পূর্ব প্রস্তুতি। এখন নাই যেহেতু, সেক্ষেত্রে তো কিছু করার নেই। আবার আমদানি শুরু হলে আমরা আবার ভ্যাকসিন দেওয়ার কার্যক্রম শুরু করতে পারবো।’
শুধু বঙ্গবন্ধু মেডিকেলই না, একইভাবে একাধিক মেডিকেল সেন্টারে জরায়ুমুখে ক্যান্সারের ভ্যাকসিনের সরবরাহ বন্ধ রয়েছে।
ইবনে সিনা মেডিকেলের এক কর্মকর্তা বলেন, জরায়ুমুখে ক্যান্সারের যে ভ্যাকসিন রয়েছে সেটার সরবরাহ বন্ধ। ফলে আমাদের কোনো শাখায় এই ভ্যাকসিনের টিকা দেওয়া হচ্ছে না।
ইমপালস হাসপাতালের নারী রোগ ও প্রসূতি বিশেষজ্ঞ ডা. কাজী ফয়েজা আক্তার বলেন, ‘এ দেশের নারীরা কয়েক ধরনের রোগে বেশী আক্রান্ত হন। এর মধ্যে- পুষ্টিহীনতা, রক্তস্বল্পতা, জরায়ুমুখে ক্যান্সার এবং ব্রেস্ট ক্যান্সার অন্যতম। ইউটেরাসের বিভিন্ন অংশের মধ্যে জরায়ুর মুখে ক্যান্সার হবার প্রবণতা সবচেয়ে বেশী।’
‘বাংলাদেশসহ উন্নয়নশীল দেশে মহিলাদের মৃত্যুর অন্যতম কারণ জরায়ুমুখের ক্যান্সার। বাংলাদেশে ক্যান্সার আক্রান্ত মহিলাদের মধ্যে শতকরা ৩০ ভাগই হচ্ছেন জরায়ুমুখের ক্যান্সারের শিকার। প্রতি বছর বাংলাদেশে প্রায় ১২ হাজার মহিলা জরায়ুরমুখের ক্যান্সারে নতুনভাবে আক্রান্ত হচ্ছে।’
বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, ভ্যাকসিন নেওয়ার মাধ্যমে মরণঘাতী এই ক্যান্সার প্রায় শতভাগ প্রতিরোধ করা যায়।
জানা যায়, জরুয়ুমুখে ক্যান্সার রোধে পূর্ব প্রস্তুতি হিসেবে ২০০৭ সালে প্রতিষেধক (ভ্যাকসিন) ব্যবহার শুরু হয় অস্ট্রেলিয়ায়। পরে ২০১৩ সালে যুক্তরাষ্ট্র খাদ্য ও ওষুধ প্রশাসনের (ইউএসএফডিএ) অনুমতি নিয়ে বাংলাদেশেও এটির বাজারজাত শুরু হয়।
আর এর ধারাবাহিকতায় যুক্তরাজ্য-ভিত্তিক ওষুধ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান গ্লাক্সোস্মিথক্লাইন (জিএসকে) তৈরি সারভারিক্স (০.৫এমএল) ও হেলথ কেয়ার ফার্মাসিউটিক্যাল লিমিটেড কর্তৃক আমদানিকৃত গার্ডাসিল (০.৫এমএল) নামে দুইটি ভ্যাকসিন দেশে বাজারজাত করে আসছিল। আরেকটি রয়েছে কোয়াড্রিভেলেন্ট ভ্যাকসিন।
এরপর থেকে বাংলাদেশে নারীরাও এই ভ্যাকসিনগুলো গ্রহণ করছিল জরায়ুমুখে ক্যান্সার প্রতিরোধে। তবে বছর দুই আগে হেলথ কেয়ারের গার্ডাসিল ও মাস ৬ আগে জিএসকের সারভারিক্স আমদানি বন্ধ করে দেয়। ফলে বাংলাদেশে জরায়ুমুখে ক্যান্সার প্রতিরোধে এখন কোনো ধরণের ভ্যাকসিন আমদানি হচ্ছে না।
জানা যায়, বাংলাদেশে অধিকাংশ ভ্যাকসিন আমদানি করতো জিএসকে। ২০১৮ সালের অক্টোবরে চিঠি দিয়ে জিএসকে বাংলাদেশে কোনো রকম ভ্যাকসিন সরবরাহ না করার সিদ্ধান্ত নেয়।
জিএসকে ২০১৮ সালের অক্টোবরে চিঠি দিয়ে কোনো রকম ভ্যাকসিন সরবরাহ না করার জানিয়ে দেয়। তারা ওষুধ ব্যবসার ক্ষেত্রে অনুকূল পরিবেশ না পাওয়ায় ও বাজারজাত করতে নানা ঝামেলার শিকার হওয়ায় ব্যবসা গুটিয়ে নিয়েছে। এর ফলে তাদের সকল ভ্যাকসিনের সাথে জরায়ুমুখে ক্যান্সারের ভ্যাকসিনও বন্ধ রয়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, দেশে উৎপাদন না থাকা ও বাইরে থেকে কোনো ধরণের আমদানি না থাকায় বতর্মানে জরায়ুমুখ ক্যান্সার প্রতিরোধী ভ্যাকসিনের তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে। অধিকাংশ মেডিকেলে ভ্যাকসিনের কোনো ধরণের সরবরাহ নেই। ফলে চাইলেও নারীরা এই সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।
তবে খোঁজ নিয়ে আরও দেখা গেছে, ইমপালস হাসপাতাল, আদ্ দ্বীন, স্কয়ার, অ্যাপোলো ও ইউনাইটেড হাসপাতালে এখনো সীমিত পরিসরে এই সেবা দেওয়া হচ্ছে।
বিভিন্ন ওষুধ কোম্পানির বিক্রয় প্রতিনিধি ও সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকদের সাথে কথা বলে এ তথ্য নিশ্চিত হওয়া গেছে।
বেসরকারি একটি ফার্মাসিউটিক্যালস কোম্পানির একজন কর্মকর্তা বলেন, মার্কেটে এখনো কিছু জিএসকের ভ্যাকসিন বড় বড় স্টেক হোল্ডারদের কাছে আছে। এর মধ্যে আদ দ্বীন ভ্যাকসিনেশন সেন্টার, স্কয়ার ভ্যাকসিনেশন সেন্টার, অ্যাপোলো ভ্যাকসিনেশন সেন্টার, ইউনাইটেড ভ্যাকসিনেশন সেন্টার। এগুলো হচ্ছে সবচেয়ে বড় স্টেক হোল্ডার। তাদের কাছে হয়তো কিছু মজুদ পাওয়া যাবে। তবে খুব সামান্য পরিমাণে আছে এই ভ্যাকসিন। যেটা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই অপ্রতুল। তাছাড়া সেটাও সময়ের ব্যবধানে শেষ হয়ে যাবে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর সার্ভিক্যাল এন্ড ব্রেস্ট ক্যান্সার স্ক্রিনিং এন্ড ট্রেনিং এ্যাটের মেডিক্যাল অফিসার (কল্পোস্কপিস্ট) ডা. কাইয়ুমা খানম কেয়া বলেন, ‘ভ্যাকসিনের সরবরাহ কিছু আছে। সরকারিভাবে নেই, প্রাইভেটভাবে ভ্যাকসিন দেওয়া হচ্ছে।’
ইমপালস হাসপাতালের নারী রোগ ও প্রসূতি বিশেষজ্ঞ ডা. কাজী ফয়েজা আক্তার বলেন, সরবরাহ একেবারে বন্ধ না। সারভারিক্স আছে, তবে গার্ডাসিল সচরাচর পাওয়া যাচ্ছে না।
অবশ্য ইমপালস হাসপাতালে এই ভ্যাকসিনগুলো পাওয়া যাচ্ছে বলে জানিয়েছেন তিনি।
এদিকে সরবরাহ বন্ধ থাকায় কিছু ফার্মেসি ইন্ডিয়া থেকে আমদানি করছে ভ্যাকসিনগুলো। এ বিষয়ে ঔষুধ কোম্পানির এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, জিএসকের সকল ভ্যাকসিন সরবরাহ বন্ধ রয়েছে। সরবরাহ বন্ধ থাকায় ক্রাইসিসের সুযোগ নিচ্ছে বড় বড় কোম্পানিগুলো। গুলশান-১ ও ২ তে বেশ কিছু ফার্মেসি আছে। তাদের কাছে এই ভ্যাকসিনগুলো আছে। তারা ভারত থেকে ভ্যাকসিন নিয়ে আসে।
তিনি বলেন, তবে এক্ষেত্রে হুমকি হচ্ছে- যেহেতু লাগেজে করে এইসব ভ্যাকসিনে ভারত থেকে আনা হয়, সেক্ষেত্রে এতে তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে থাকে না। ফলে এই ভ্যাকসিন দেওয়ার ফলে ক্ষতি না হলেও লাভ হয় না। এতে করে ব্যবসায়ীদের ব্যবসা হচ্ছে, কিন্তু মানুষ উপকার পাচ্ছে না।
ভ্যাকসিন সরবরাহ না থাকার ব্যাপারে হেলথ কেয়ার ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেডের প্রোডাক্ট ম্যানেজার মিনহাজুর রহমান বলেন, আমরা বিদেশি এক কোম্পানির কাছ থেকে গার্ডাসিল সরবরাহ করি। তবে প্রায় দুই বছর ধরে বন্ধ রয়েছে সরবরাহ। ফলে মার্কেটে গার্ডাসিলের সরবরাহ নেই।
তিনি বলেন, আমরা আশা করছি অক্টোবর থেকে বাংলাদেশে গার্ডাসিল আমদানি করতে পারবো।
সূত্র: অমৃতবাজার