ইসলাম ও অন্যান্য ধর্মে তালাক !!!
ইসলাম আকিদা-বিশ্বাস, ইবাদত-বন্দেগি ও লেনদেনের ক্ষেত্রে যেমন মানুষকে সঠিক দিকনির্দেশনা দিয়ে থাকে, তেমনি পারিবারিক ও সামাজিক আচার-আচরণসহ মানবজীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রেই ইসলামের রয়েছে নিখুঁত ও সুনিপুণ নির্দেশনা। বৈবাহিক সম্পর্কের মাধ্যমে সর্বপ্রথম দাম্পত্য জীবন ও পারিবারিক জীবনের সূচনা হয়। ইসলামে এ সম্পর্ক স্থাপনে যেমন সুনির্ধারিত বিধান রয়েছে, তেমনি প্রয়োজনে তা ছিন্ন করারও নীতিমালা রয়েছে। প্রথমে আমরা দেখব, তালাক সম্পর্কে কোন ধর্মের দৃষ্টিভঙ্গি কেমন। ইহুদিদের ধর্মে তালাক ইহুদিদের বর্তমান প্রচলিত ধর্মগ্রন্থ অনুযায়ী স্ত্রীকে তালাক দেওয়া অনুমোদিত। কোনো কারণ ছাড়াই ব্যাপক হারে যখন-তখন স্ত্রীকে তালাক দেওয়া যাবে। তবে তালাক দিতে হবে কেবল লিখিতভাবে। (বাইবেল, দ্বিতীয় বিবরণ : ২৪/১-৪) পরে তাদের ধর্মে তালাক দেওয়ার ওপর কিছু শর্ত আরোপ করা হয়। একাদশ শতাব্দীতে এর লাগাম টেনে ধরার চেষ্টা করা হয়। ইহুদিদের ধর্ম মতে, তালাক কেবল স্বামীই দিতে পারবে। স্ত্রীর যত সমস্যাই হোক না কেন এবং স্বামীর যত ত্রুটিই থাকুক না কেন, স্ত্রী তার কাছ থেকে কোনোভাবেই তালাক নিতে পারবে না। তাদের কিছু কিছু গ্রন্থে অবশ্য বিশেষ অবস্থায় স্বামীর কাছ থেকে স্ত্রী তালাক চাইতে পারবে বলে জানা যায়। (এনসাইক্লোপিডিয়া অব ব্রিটানিকা : ২/৪৫৩) ইহুদি ধর্মে তালাকপ্রাপ্ত স্ত্রী অন্য স্বামীর ঘর থেকে ফিরে আসার পর পুনরায় প্রথম স্বামীর কাছে ফিরে আসার কোনো সুযোগ নেই। কেননা এমতাবস্থায় নাকি ওই মহিলা চিরতরে নাপাক হয়ে যায়। (বাইবেল, দ্বিতীয় বিবরণ : ২৪/১-৪, জিরমিয় : ৩/১) খ্রিস্টধর্মে তালাক খ্রিস্টধর্মে তালাক একেবারেই নিষিদ্ধ। স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কে যত ফাটল বা বৈরিতা তৈরি হোক না কেন, কিছুতেই তালাকের অনুমতি নেই। এ বিধান বর্তমান প্রচলিত ইনজিল কিতাবেও আছে। যেমন বর্ণিত হয়েছে, ‘স্বামী-স্ত্রী দুইজন মিলে একটি দেহ। অতএব প্রভু যাদের একত্রিত করেছেন, মানুষ তাদের পৃথক করতে পারে না।’ (ইনজিল, মথি : ১৯/৩-১২) তবে মানুষের সাধারণ স্বভাববিরোধী এ বিধান মানতে গিয়ে যখন অনেক ক্ষেত্রে তারা কোণঠাসা হয়ে পড়ে, তখন তারা বিধানটি এভাবে বানিয়ে নেয় যে যখন পারিবারিক সম্পর্ক একেবারেই শোচনীয় হয়, তখন কেবল শারীরিকভাবে পৃথক হওয়ার বিধান রয়েছে। এর চেয়ে বেশি কিছু নয়। এভাবে বৈবাহিক সম্পর্ক চিরদিন অটুট থাকবে। উভয়ের বিছানা আলাদা থাকবে। তবে উভয়ে পৃথক হয়ে অন্য স্বামী বা স্ত্রী গ্রহণের কোনো সুযোগ নেই। স্বামী-স্ত্রী উভয়ের জন্য দ্বিতীয় বিবাহ সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। দ্বিতীয় বিবাহ করা আর ব্যভিচার করা একই কথা। (ইনজিল, মারকুস : ১০/৩-১২, লুক সমাচার : ১৬/১৮) এ কঠিন বিধান পালন করতে গিয়ে খ্রিস্টানরা যখন অতিষ্ঠ হয়ে পড়ে, তখন নতুন বিধান করা হলো যে কিছু কিছু অবস্থায়, যেমন স্ত্রী ব্যভিচারী হওয়া, স্বামী নপুংসক হওয়া, ধর্মত্যাগ ইত্যাদি কারণে গির্জার রায়ের মাধ্যমে উভয়ে তালাক নেওয়ার দ্বারা পৃথক হতে পারবে। তবে তা কেবল গির্জার অধিকার, স্বামী-স্ত্রী নিজেদের মধ্যে এ বিষয়ে কোনো কর্তৃত্ব নেই। গির্জার এ একচ্ছত্র ক্ষমতাসংবলিত বিধান ১৮৫৭ ইং সাল পর্যন্ত বলবৎ থাকে। পরে এ ক্ষমতা সাধারণ বিচারালয়ের ওপর হস্তান্তর করা হয়। বর্তমানে খ্রিস্টান স্বামী-স্ত্রী যে কারো যখন-তখন ইচ্ছা হলেই একে অন্যকে তালাক দিয়ে পৃথক হয়ে যায়। হিন্দু ধর্মে তালাক হিন্দু ধর্মেও তালাক সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। তাই কোনো নারী ব্যভিচারে লিপ্ত হলে তাকে ধর্ম থেকে বহিষ্কার করে দেওয়া হবে। তালাকের কোনো বিধান নেই। তবে হিন্দুরা যখন অনুভব করে যে তাদের এই বিধান পালন খুবই কঠিন, তখন তাদের কোনো কোনো সম্প্রদায় এ বিধান প্রণয়ন করে, স্বামী ধর্মগুরুর কাছ থেকে তালাকের অনুমতি নিতে পারবে। কিন্তু এখন পর্যন্ত হিন্দুদের কোনো কোনো সম্প্রদায় তাদের আগের বিধানের ওপর অটল রয়েছে। (এনসাইক্লোপিডিয়া অব ব্রিটানিকা : ৭/৪৫৩) ইসলাম ধর্মে তালাক ইসলাম তালাকের ব্যাপারে বাড়াবাড়ি ও ছাড়াছাড়ি উভয় প্রকারের প্রান্তিকতা ছেড়ে ন্যায়-ইনসাফের সঙ্গে স্বামী-স্ত্রী উভয়েরই স্বার্থ সুরক্ষার নিশ্চয়তা দিয়েছে। মূলত বিবাহের মাধ্যমে যে দাম্পত্য সম্পর্কের সূচনা হয়, তা অটুট থাকা এবং আজীবন স্থায়িত্ব লাভ করাই ইসলামে কাম্য। তাই স্বামী-স্ত্রীকে এ সম্পর্ক ছিন্ন করতে এবং বিবাহবিচ্ছেদের পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে নিরুৎসাহিত করা হয়েছে। তাই যেসব কারণে দাম্পত্য সম্পর্ক ছিন্ন হওয়ার উপক্রম হয়, সেগুলো দূর করার জন্য ইসলাম বিভিন্ন বিধান দিয়েছে। এ বিষয়ে কোরআন-হাদিসে অনেক নির্দেশনা রয়েছে। নিম্নে এর কিছু বর্ণনা দেওয়া হলো— প্রথমত, বিবাহের আগে বর কনেকে ভালোভাবে দেখে নেবে, যাতে বুঝে-শুনেই বিবাহটা সম্পন্ন হয় এবং কোনো ধরনের দৈহিক ত্রুটির কারণে যেন সম্পর্ক ছিন্ন হওয়ার উপক্রম না হয়। দ্বিতীয়ত, স্বামী সব সময় কেবল স্ত্রীর দোষ-ত্রুটির দিকেই দেখবে না, তার মধ্যে যেসব ভালো গুণ বিদ্যমান, সেগুলোর দিকে তাকিয়ে অপছন্দের দিকগুলো ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবে। মহান আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘যদি তাকে তোমার অপছন্দও হয়, তবুও তুমি যা অপছন্দ করছ আল্লাহ তাতে সীমাহীন কল্যাণ দিয়ে দেবেন।’ (সুরা : নিসা, আয়াত : ১৯) রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন, ‘কোনো মুমিন পুরুষ মুমিন নারীর ওপর রুষ্ট হবে না, কেননা যদি তার কোনো কাজ খারাপ মনে হয় তাহলে তার এমন গুণও থাকবে, যার ওপর সে সন্তুষ্ট হতে পারবে।’ (মুসলিম : ১৪৬৯) আরবি থেকে ভাষান্তর : মুফতি মাহমুদ হাসান