হ্যালুসিনেশন কি কেন হয়?
পঞ্চইন্দ্রিয়ের কাজ হলো, একেক ধরনের অনুভূতি জাগায়। শ্রবণেন্দ্রিয় শব্দের অনুভূতি জাগায়, ত্বক স্পর্শানুভূতি জাগায়, জিহ্বা স্বাদের অনুভূতি জাগায়, নাক গন্ধের অনুভূতি জাগায়, আর চোখ দর্শনের অনুভূতি জাগায়। ধরুন, হঠাৎ করে আপনার পকেটে থাকা মোবাইল ফোনটি বেজে উঠলো কিংবা ভাইব্রেট হলো, কিন্তু পকেট থেকে বের করেই দেখলেন, না, ফোনটা বাজছেও না আবার ভাইব্রেটও হচ্ছে না! হ্যাঁ, ঠিক তখনই আপনার হ্যালুসিনেশন হয়েছে!
হ্যালুসিনেশন শব্দটির সঙ্গে আমরা পরিচিত। অনেকে ইলিউশন বা দৃষ্টিভ্রমকে হ্যালুসিনেশনের সঙ্গে গুলিয়ে ফেলেন। ইলিউশন ও হ্যালুসিনেশন বিস্তৃত আঙ্গিকে বোঝার জন্য ইলিউশন সম্পর্কে একদম স্বচ্ছ ধারণা থাকা দরকার। হ্যালুসিনেশন আর ইলিউশন দু’টোই একধরণের বিভ্রান্তি। তবে ইলিউশনে উদ্দীপক থাকবে, হ্যালুসিনেশনে এমন কোনো উদ্দীপক থাকবে না। সামনের ঝুলে থাকা দড়ি যদি কারো কাছে সাপ মনে হয় তাহলে এটি ইলিউশন। যদি কোনো দড়ির অস্তিত্ব ছাড়াই সাপ দেখতে পায় তাহলে তা হ্যালুসিনেশন।
হ্যালুসিনেশন শব্দটি উচ্চারণে যেমন একটা মজা আছে তেমনি কৌতুহল তৈরি করার মতো এর নানাবিধ উপস্থাপনাও দেখা যায়। কেউ বিষয়টিকে দেখেন একটা মজার বিষয় হিসেবে, কেউ রহস্যময়, কেউ এটাকে নাটক বা উপন্যাসের বিশেষ উপকরণ হিসেবে কেউ আবার বিশেষ ক্ষমতা প্রাপ্তির সঙ্গে হ্যালুসিনেশনকে তুলনাও করে থাকেন। কিন্তু আর যাই হোক, এটি মোটেই মজার কোনো বিষয় নয়। এটি এমন এক দশা যখন কেউ মিথ্যা জালের ভেতরে বসবাস করে অজান্তেই। আসলে মিথ্যার জগতে বসবাস করে কেউ ভাবে সে বাস্তব জগতে বসবাস করছে। এটি এক ধরনের অস্বাভাবিক এবং অদ্ভুত অনুভূতি। এ অনুভূতি স্বাভাবিক অনুভূতির মতোই ঘটে থাকে।
হ্যালুসিনেশন কোনো রোগ নয়, এটি অন্য রোগের উপসর্গ। এটি সাধারণত মানসিক রোগের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। তবে কিছু ক্ষেত্রে শারীরিক প্রতিবন্ধকতা থেকেও হ্যালুসিনেশন হতে পারে। তাই কেবল হ্যালুসিনেশন দিয়ে কোনো নির্দিষ্ট রোগ নির্ণয় করা সম্ভব নয়। বিভিন্ন কারণে হ্যালুসিনেশন ঘটতে দেখা যায়-
(১) সিজোফ্রেনিয়া, সিভিয়ার মুড ডিসঅর্ডার, ডিল্যুশনাল ডিসঅর্ডারে রোগীর প্রায়ই হ্যালুসিনেশন হতে পারে
(২) মাত্রাতিরিক্ত ড্রাগস বা অ্যালকোহল সেবনের কারণে
(৩) মস্তিষ্ক, স্নায়ুতন্ত্র এবং ইন্দ্রিয়ের সমস্যায় হ্যালুসিনেশন হতে পারে।
(৪) শরীরে লবণের তারতম্যের জন্যও স্বল্পমেয়াদের হ্যালুসিনেশন দেখা দিতে পারে।
(৫) প্রচণ্ড জ্বর হলে বিশেষ করে শিশুদের হ্যালুসিনেশন হয়। মৃগীরোগ, বিষন্নতা, হিস্টিরিয়া এমনকি ব্রেইন টিউমারের বেলাতেও হ্যালুসিনেশন ঘটতে পারে।
(৬) লিভার বা কিডনির সমস্যা প্রভৃতি মারাত্মক রোগে আক্রান্ত হলে।
হ্যালুসিনেশন হলো এমনি একটি মানসিক অবস্থা যেখানে ব্যক্তি কোনো প্রকার উদ্দীপনা ছাড়াই বিশেষ ইন্দ্রিয়ানুভূতি লাভ করে। এ অনুভূতির সঞ্চার স্বাভাবিক অনুভূতির মতোই ঘটে। ধরা যাক, কোনো ব্যক্তির সঙ্গে এমন ঘটছে, সে বিশেষ সময়ে কোন ধরণের গায়েবি কথা শুনছেন। তার মানে ঐ ব্যক্তির শ্রবণেন্দ্রিয়ের হ্যালুসিনেশন ঘটছে। এ গায়েবি কথা খুব হাল্কাভাবে ঘটে কিংবা তাতে অস্পষ্টতা থাকে এমন নয় কিন্তু। আশপাশের লোকজনের কথা সে যেমনভাবে শুনতে পায়, কানের মধ্যে আসা গায়েবি কথাও ঠিক তেমনভাবেই তার সঙ্গে ঘটে থাকে। হ্যালুসিনেশন দেহের প্রতিটি ইন্দ্রিয়তে ঘটতে পারে।
হ্যালুসিনেশনকে দু’টি শ্রেণীতে ভাগ করা যেতে পারে। একটি হচ্ছে হিপনেজোগিক হ্যালুসিনেশন যখন মানুষ ঘুমিয়ে থাকে তার দশ সেকেন্ড থেকে কয়েক মিনিটের মধ্যে যা ঘটে থাকে, আর অন্যটি হচ্ছে হিপনোপমপিক হ্যালুসিনেশন যখন মানুষ জেগে উঠে তারপর যা ঘটে থাকে। তবে আমাদের পঞ্চ ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে হ্যালুসিনেশন হয়ে থাকার কারণে ইন্দ্রিয়ের ওপর ভিত্তি করে হ্যালুসিনেশনের বেশ কিছু ধরনকে বিশেষজ্ঞরা শণাক্ত করতে পেরেছেন। যেমন :
ভিজুয়াল বা দৃষ্টিতে হ্যালুসিনেশন: এক্ষেত্রে এমন কিছু দেখা, যার কোনো বাস্তবিক ভিত্তি নেই। হতে পারে সেটা কোনো আকারের-বর্ণের কিংবা আলোর ছটা, যা অবাস্তব মানব আকৃতি বিশেষ। যেমন মনে হতে পারে পেছনে কেউ দাঁড়িয়ে আছে। অথচ তখন পেছনে বা আড়ালে বস্তুত কেউই নেই।
অডিটরি বা শ্রুতিগত হ্যালুসিনেশন: এমন কোনো শব্দ, মিউজিক হইচই কিংবা কণ্ঠস্বর শোনা, যা নিতান্তই অলীক। এক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি যেটা হয়ে থাকে, তা হলো ক্ষতিকর গায়েবি কথা, আদেশমূলক কিংবা নিষেধমূলক কথা শোনা। এসব কথা মস্তিষ্কের ভেতর বা বাইরে থেকে হতে পারে। পুরুষ কিংবা নারীকণ্ঠ হতে পারে, অপরিচিত কিংবা পরিচিত মনে হতে পারে। সিজোফ্রেনিয়া রোগীর ক্ষেত্রে অডিটরী হ্যালুসিনেশন বেশি হয়ে থাকে।
অলফ্যাক্টরি বা ঘ্রাণজনিত হ্যালুসিনেশন: এক্ষেত্রে হ্যালুসিনেশনে আক্রান্ত ব্যক্তি এমন কিছু জিনিসের ঘ্রাণ অর্থাৎ গন্ধ পাবে, যার কোনো সত্যতাই নেই, শুধুই একটি ভ্রান্ত ধারণা। যেমন: হঠাৎ করে পঁচা মাছের গন্ধ, বমি, প্রস্রাব, সিগারেট এমনকি পঁচা লালার গন্ধও পেতে পারে। এটি মূলত হয়ে থাকে অলফ্যাক্টরি সিস্টেমের স্নায়ুকোষের ক্ষতিগুলো থেকে, যা ভাইরাস ইনফেকশন ব্রেন টিউমার ট্রমা, সার্জারি কিংবা ওষুধের কারণে হয়ে থাকে।
গ্যাস্টেটরি বা স্বাদজনিত হ্যালুসিনেশন: কোনো কিছুর স্বাদকে মুখে বিস্বাদ লবণাক্ত বা মেটালিক মনে হয়, সম্পূর্ণটাই ভুল ধারণা। সাধারণত এপিলেপসি রোগে এ ধরনের হ্যালুসিনেশন হয়ে থাকে। টমেটো, আলু, বেগুন, মরিচ জাতীয় খাবারে ‘সোলানিন’ নামক উপাদান থাকে যেটি হ্যালুসিনেশনে প্রভাব রাখতে পারে। তাছাড়া কফি অতিরিক্ত পান করলেও হ্যালুসিনেশনের সম্ভাবনা বেড়ে যায়।
সোমাটিক বা স্পর্শগত হ্যালুসিনেশন: এক্ষেত্রে কোনোকিছুর স্পর্শ অনুভূত হওয়া, যা বাস্তবিকভাবে ঘটেনি। যেমন হঠাৎ করে শরীরের ভেতর বা উপরে কিছু উঠে আসছে মনে হওয়া। অন্ধকার ঘরে মনে হবে কেউ স্পর্শ করছে অথচ ঘরে তখন কেউ নেই। এটি মূলত একটি মেডিকেল ডিসঅর্ডার।
কারো প্রেমের সম্পর্ক ভেঙে গেলে কিংবা প্রিয় কোনো মানুষকে হারিয়ে ফেললে সেই মানুষটিকে নিয়ে হ্যালুসিনেশন হওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি থাকে বলে পরীক্ষা করে দেখা গেছে। হ্যালুসিনেশনের রোগীদের সঙ্গে এমনো হতে পারে, কাছের কোনো একজন মানুষের নাম ধরে গায়েবি কথাবার্তায় সে শুনতে পায়। ক্রমাগত হ্যালুসিনেশন হওয়ায় ঘটে যাওয়া কিংবা শোনা সবকিছুকেই মানুষটি সত্যি মনে করতে থাকে। যার জন্য অনেক বিপদও ঘটে থাকে। সুতরাং এসব বিষয়গুলোকে দ্রুত বুঝে শণাক্ত করা খুবই জরুরি। যত তাড়াতাড়ি তাদের চিকিৎসার আওতায় আনা যায় ততই মঙ্গল।
সূত্র: ডেইলি বাংলাদেশ