যে দশটি প্রাণঘাতী রোগ সম্পর্কে না জানলেই নয়
মধ্য আফ্রিকায় সাম্প্রতিক সময়ে ইবোলা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের পর দক্ষিণ ভারতে আরেকটি প্রাণঘাতী ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ছে – আর সেটি হলো নিপাহ ভাইরাস।দুটি ভাইরাসই বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বড় ধরনের প্রাদুর্ভাব হতে পারে এমন প্রাণঘাতী রোগের তালিকায় আছে।
২০১৫ সাল থেকেই বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা অগ্রাধিকারে থাকা প্রাণঘাতী রোগগুলোর একটি তালিকা করেছে যেগুলো নিয়ে আরও গবেষণার প্রয়োজন।সংস্থাটি এসব রোগকে জনস্বাস্থ্যের জন্য বড় ধরনের ঝুঁকি হিসেবে বিবেচনা করছে কারণ এগুলা মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়তে পারে।আর বিজ্ঞানী বা গবেষকদের হাতে এসব বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে ঔষধ বা টীকার মতো প্রয়োজনীয় উপকরণ নেই।
ইবোলা ও নিপাহ ভাইরাসের মতো ওই তালিকায় এমন আরও আটটি রোগ রয়েছে।
নিপাহ ভাইরাস
নিপাহ ভাইরাস বাদুড় থেকে পশুপাখি ও মানুষের মধ্যেও সংক্রমিত হতে পারে।জ্বর, বমি কিংবা মাথা ব্যথা এ রোগের লক্ষ্মণ।মানুষ কিংবা পশুপাখি কারও জন্যই কোন প্রতিষেধক এখনো বের হয়নি।এ রোগে মৃত্যুর হার ৭০ শতাংশ।
১৯৯৮ সালে মালয়েশিয়ায় শূকরের মধ্যে প্রথম এ রোগ চিহ্নিত হওয়ার পর সেখানকার কৃষি শহর নিপাহ’র নামে ভাইরাসটির নামকরণ হয়েছে।পশুপাখি থেকে প্রায় তিনশ মানুষের এ ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে যার মধ্যে অন্তত একশ জনের মৃত্যু হয়েছে।
হেনিপেভিরাল রোগ
হেনড্রা ভাইরাস প্রথম চিহ্নিত হয় অস্ট্রেলিয়ায়। এটাও বাদুড় থেকেই থেকেই হয় এবং ঘোড়া ও মানুষ ভয়াবহ আক্রান্ত হতে পারে।
১৯৯৪ সালে ব্রিসবেনের একটি শহরতলীতে এটির প্রথম প্রাদুর্ভাব দেখা যায়। এর পর থেকে অন্তত ৭০টি ঘোড়া এতে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছে আর আক্রান্ত সাত জনের মধ্যে চার জন মারা গেছে।
সিসিএইচএফ
ক্রাইমিয়ান কঙ্গো হেমোরেজিক ফিভার বা সিসিএইচএফ এক ধরনের এঁটেল পোকা (টিকস পতঙ্গ) থেকে ছড়ায়, যা মানুষের মধ্যে বড় প্রাদুর্ভাবের কারণ হতে পারে। এতে মৃত্যু হার ৪০ শতাংশ।
ক্রাইমিয়াতে ১৯৪৪ সালে প্রথম ও পরে কঙ্গোতে এটি চিহ্নিত হয়। ভাইরাসটি পুরো আফ্রিকা, বলকান অঞ্চল ও মধ্যপ্রাচ্য এবং এশিয়ার কিছু এলাকায় পাওয়া যেতে পারে।এই রোগে হঠাৎ করেই কেউ আক্রান্ত হতে পারে যার লক্ষ্মণ মাথাব্যথা,বেশি জ্বর, মেরুদণ্ড ব্যথা, পাকস্থলীতে ব্যথা ও বমি।
ইবোলা ভাইরাস
ধারণা করা হয় এটিও প্রথম বাদুড় থেকেই এসেছে এবং ১৯৭৬ সালে কঙ্গোর ইবোলা নদীর কাছে এটির প্রথম প্রাদুর্ভাব দেখা যায়। বন্য প্রাণী থেকে এটি মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়তে পারে। আবার মানুষ থেকে মানুষেও এটি ছড়াতে পারে।ভয়াবহ এই রোগে মৃত্যু হার ৫০শতাংশের মতো। ২০১৪ ও ২০১৬ সালে মধ্য আফ্রিকায় বড় প্রাদুর্ভাবে অন্তত ১১ হাজার মানুষ মারা গেছে।
মারবুর্গ ভাইরাস
এটি প্রায় ইবোলার কাছাকাছি একটি ভাইরাস। আক্রান্ত ব্যক্তির কাছ থেকে অন্য কেউ এতে সংক্রমিত হতে পারে। ইবোলার মতোই এর উৎস হিসেবে বাদুড়কেই ভাবা হয়। এতে আক্রান্ত হলে আট থেকে নয় দিনের মধ্যেই কারও মৃত্যু হতে পারে।জার্মান শহর মারবুর্গের নামে এর নামকরণের কারণ হলো ১৯৬৭ সালে এখানে প্রথম ভাইরাসটি শনাক্ত হয়। পরে তা ফ্রাঙ্কফুর্ট ও সার্বিয়ার রাজধানী বেলগ্রেডেও ছড়িয়ে পড়ে।
সার্স
সার্স অর্থাৎ সিভিয়ার একিউট রেসপিরেটরি ভাইরাসের উৎপত্তি চীনে। বিজ্ঞানীরা বলছেন খাটাশ জাতীয় বিড়াল থেকে ভাইরাসটি এসেছে । তবে এটিও বাদুরের সঙ্গে সম্পর্কিত।২০০২ থেকে ২০০৪ সালের মধ্যে দু’বার এর প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়। আট হাজারের বেশি আক্রান্তের মধ্যে ৭৭৪ জনের মৃত্যু হয়। ভাইরাসটিতে আক্রান্ত হলে ভয়াবহ শ্বাসকষ্ট দেখা দেয়। তবে ২০০৪ সালের পর থেকে এ ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার খবর পাওয়া যায়নি।
মার্স
এটি সার্সের একই গোত্রীয় একটি ভাইরাস। ২০১২ সালে প্রথম সৌদি আরবে এই ভাইরাসের অস্তিত্ব আবিষ্কৃত হয় এবং সেখানে আক্রান্তদের ৩৫শতাংশ মারা গেছেন।এই রোগের নাম দেওয়া হয় মিডল ইস্ট রেসপিরেটরি সিনড্রোম বা সংক্ষেপে মার্স। করোনা ভাইরাস গোত্রীয় বলে ভাইরাসটির নাম মার্স করোনা ভাইরাস। সৌদি আরব ছাড়াও এর উপস্থিতি লক্ষ করা গেছে ওমান, আরব আমিরাত, মিসর ইত্যাদি মধ্যপ্রাচ্যের বেশ কটি দেশে।
ধারণা করা হচ্ছে, মানবদেহে এই ভাইরাস এসেছে উট থেকে। কাতার, ওমান, সৌদি আরব ও মিসরে উটের রক্তেও মার্স ভাইরাসের অস্তিত্ব পেয়েছেন বিজ্ঞানীরা। এ ছাড়া সৌদি আরবে বাদুড়ের রক্তেও পাওয়া গেছে এই ভাইরাস। মানুষ থেকে মানুষে ভাইরাস ছড়িয়েছে হাঁচি, কাশি, নিকট অবস্থান ইত্যাদি থেকে।
রিফট ভ্যালি ফিভার (আরভিএফ)
মশা বা রক্ত খেয়ে থাকে এমন পতঙ্গ থেকে এই ভাইরাসের সূচনা হয় যা গরু বা ভেড়াকে আক্রান্ত করে থাকে। কিন্তু এটিও পরে মানবশরীরে সংক্রমিত হতে পারে। বেশী আক্রান্ত হলে মানুষের নানা অঙ্গ প্রত্যঙ্গ অকার্যকর হয়ে যেতে পারে। মূলত আক্রান্ত পশু থেকে এটি মানুষের শরীরে আসে।এমনকি আক্রান্ত গরু বা ভেড়ার দুধ থেকেও এটি সংক্রমিত হতে পারে। ১৯৩১ সালে কেনিয়ার রিফট ভ্যালিতে প্রথম এ ভাইরাসটি চিহ্নিত হয়।
জিকা ভাইরাস
মশার মাধ্যমে দ্রুত এ ভাইরাসটি ছড়ায়। ভাইরাসটির সংক্রমণ ঘটেছে এমন কোনো রোগীকে এডিস মশা কামড়ানোর মধ্য দিয়ে এর স্থানান্তর হয়। পরে ওই মশাটি অন্য ব্যক্তিদের কামড় দিলে তা ছড়াতে থাকে।এরপর ওই ব্যক্তিদের মাধ্যমেই ভাইরাসটির বিস্তার ঘটতে থাকে। তবে যৌন সংসর্গের মাধ্যমেও রোগটি ছড়াতে পারে। উগান্ডার জিকা ফরেস্ট এলাকায় বানরের মধ্যে ১৯৪৭ সালে এটি আবিষ্কৃত হয়। তবে আফ্রিকা ও এশিয়ায় এ ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়।
লাসা জ্বর
লাসা জ্বর সংক্রমিত চর্বি, ইঁদুরের প্রস্রাব দ্বারা দূষিত খাদ্য এবং ইঁদুরের স্পর্শ করা খাবার থেকে ছড়ায়।এই রোগে আক্রান্ত হলে জ্বরের সঙ্গে শরীরের বিভিন্ন অংশে রক্তক্ষরণ হতে পারে এবং চোখে ও নাকে সংক্রমণ হতে পারে। লাসা জ্বরটি পশ্চিম আফ্রিকা বিশেষ করে নাইজেরিয়াতেই বেশি দেখা যায়। দেশটির লাসা শহরে এ রোগটি প্রথম দেখা দিয়েছিল ১৯৬৯ সালে।
ডিজিজ এক্স
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা পৃথিবীব্যাপী মহামারি ঘটাতে পারে এমন অসুখের তালিকায় নতুন রহস্যময় অসুখ ‘ডিজিজ এক্স’ এর নাম অন্তর্ভুক্ত করেছে।ডিজিজ এক্স শুনে অপরিচিত মনে হতে পারে। এটি কোন রোগের নামও নয়।তালিকায় থাকা এই নামের ব্যাপারে ব্যাখ্যা করা হয়েছে, ডিজিজ এক্স হলো এমন কোনও রোগ যা মানবজাতির কাছে এখনো অজানা, কিন্তু তা আন্তর্জাতিকভাবে মহামারীর রূপ নিতে পারে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা জানিয়েছে, ‘একটা অজানা রোগে পৃথিবীজুড়ে ব্যাপক মহামারী দেখা দিতে পারে বলে আমরা অনুমান করছি এটা বুঝাতেই ‘ডিজিজ এক্স’ সম্ভাব্য মহামারীর তালিকায় যোগ করা হয়েছে।’
সূত্র-বিবিসি বাংলা