খুবই চেনা এই ফলটি ভয়ংকর যেসব রোগের ওষুধ সবার জানা দরকার
ডুমুর আদিকাল থেকেই ভেষজ হিসেবে ব্যবহার হয়ে আসছে। ডুমুরের পাতা প্রসূতি ঘরে রাখার বিধান আদিকালের।
আমাদের দেশে সাধারণত দু’ধরনের ডুমুর দেখা যায়; যথা কাকডুমুর ও যজ্ঞ ডুমুর। কাকডুমুরের পাতা যজ্ঞডুমুরের পাতা থেকে বড় ও বেশি খসখসে। তাই একে খরপত্রীও বলে। এ ছাড়া রয়েছে বরাডুমুর। জয়া ডুমুর ও কালিফোর্নিয়ান ডুমুর (আঞ্জির নামে পরিচিত) ইত্যাদি।
ডুমুর দামে সস্তা, কিন্তু তরকারি খুবই পুষ্টিকর। এ দেশের হিন্দুদের ঘরে এটি খুবই সমাদৃত ও বহুল প্রচলিত তরকারি হলেও স্বাস্থ্য সচেতনতার অভাবে মুসলমান ঘরে এটি যথার্থ দাম পায় না।
তা ছাড়া ডুমুর কুটতে বেশি সময় লাগে বলে আজকের ব্যস্ততার দিনে এটির ব্যবহার কমে যাচ্ছে। কিন্তু সস্তায় এমন টনিক ও স্বাদু খাবার আর নেই। ভেষজগুণেও এটি ভরপুর। কাকডুমুর শ্বেতী রোগের মহৌষধ।
চরকের মতে ‘শ্বিত্রে স্নংসনমগ্র্যং মলপুরস ইষ্যতে সগুড় অর্থাৎ শ্বৈতী রোগে প্রধান কাজ হলো এমন কিছু খাওয়া যেন মলপুর (ডুমুর) কাজ সাধন হয়; এর জন্য মলপু ফলের রস ও একটু গুড় খাবে।
চক্রদত্তের মতে, এটি কাকডুমুর ভগন্দর ফাটিয়ে দেয়, বিষাক্ত পুঁজ ও রক্তক্ষরণ করিয়ে তা সারিয়ে দেয়। চরক সংহিতায় বর্ণনা আছে যে, এ ফলটি কাঁচা ও পাকা অবস্থায় কৃশতা সারায়, এটি গুরুপাক ও শীতবীর্য; রক্তপিত্তে বিশেষ উপকারী। ভাবপ্রকাশের মতে এটি শ্বেতী ও রক্তপ্রদর সারায়।
কাকডুমুর ধারক, কামোদ্দীপক, রক্তপরিষ্কারক, তবে বাতকর; বমনকারক। এর ছালের ক্বাথ সোরিয়াসিস, পাণ্ডু (জন্ডিস) ও কামলারোগ ও রক্তপিত্তে (নাক, মুখ দিয়ে রক্ত পড়া) উপকারী। জ্বর নিবারণের জন্য এর ছালের গুঁড়ো ১-২ গ্রাম মাত্রায় দিনে তিন-চার বার খাওয়াতে হয়।
অল্প মাত্রায় খেলে এটি টনিকের কাজ করে। ফলের গুঁড়ো গরম পানিতে মিশিয়ে বাগীতে পুলটিশ দিলে উপকার হয়। কারো কারো মতে, কাকডুমুরের ফল খেলে অকালে গর্ভপাত নিবারণ হয়। অনেকে দুধ ঘন করার জন্য গরু-মহিষকে ডুমুরের ফল খাওয়ায়। নিচে কাকডুমুরের ভেষজ ব্যবহারবিধি দেয়া হলো।
ভস্মকাগ্নি : একে লোকজ কথায় বলে খাই-খাই করা রোগ। এ রোগের উৎপত্তি বায়ুধিকার প্রধান অগ্নিমান্দ্যে এবং এর চিকিৎসা না করলে কৃশতা রোগ অনিবার্য। এ রোগ হলে কাকডুমুরের ফলের রস ২ চা-চামচ করে প্রতিদিন এক-দুই বার করে খেলে দুই-তিন দিনেই ফল দেখা যায়।
অপুষ্টিজনিত কৃশতা : এ ক্ষেত্রে পাকা কাকডুমুর কেটে পোকা আছে কি না দেখে নিয়ে তারপর রোদে শুকাতে হবে। এরপর প্রতি ৫ গ্রাম মাত্রায় আধাকাপ দুধ ও ২ কাপ পানিতে সিদ্ধ করে আন্দাজ আধা কাপ থাকতে নামিয়ে ডুমুরসহ সে পানি খেতে হবে।
শোথে অপুষ্টি : এ ক্ষেত্রে কাকডুমুরের পাকা ফলের রস ২ চা-চামচ মাত্রায় একটু গরম করে প্রতিদিন একবার অথবা দুইবার খেতে হবে। এতে বুকের দুর্বলতাও কমবে, শোথও সারবে।
রক্তপিত্ত : পাকা কাকডুমুর ছোট হলে ৩টি, বড় হলে ২টি পানিতে মিশিয়ে নিংড়ে পাতলা ন্যাকড়ায় ছেঁকে ওই পানি দিনে ২-৩ বার খেলে ২-৩ দিনের মধ্যে রক্ত ওঠা বন্ধ হবে, গলার সুড়সুড়ি ও কাশি থাকবে না।
প্রদর : রক্ত ও শ্বেতপ্রদরে কাকডুমুর গাছের কাঁচা ছাল ১০ গ্রাম একটু থেঁতো করে ৩ কাপ পানিতে সিদ্ধ করার পর আন্দাজ এক কাপ থাকতে নামিয়ে, ছেঁকে ওই পানি সকাল ও বিকেলে খেতে হবে। এর দ্বারা রক্তপ্রদরও সারবে। শ্বেতপ্রদরও কিছু দিন ধরে ব্যবহার করলে সারবে। তবে এ ছালসিদ্ধ পানি দিয়ে ধুয়ে দিলে এ রোগ তাড়াতাড়ি সারবে।
পেটের দোষ : পেটের দোষ যদি বারো মাসই চলে, তবে সে ক্ষেত্রে কাকডুমুর গাছের গোড়ার দিকে শুকনো ছাল, ১০ গ্রাম নিয়ে একটু থেঁতলে ৪ কাপ পানিতে সিদ্ধ করার পর এক কাপ থাকতে নামিয়ে ছেঁকে সে পানি সকাল ও বিকেলে ২ ভাগ করে খেতে দিতে হবে।
শ্বেতী রোগ : শ্বেতী রোগের বেলায় পেটের দোষের নিয়মে খেলে ধীরে ধীরে দাগগুলোর রঙ স্বাভাবিক হতে শুরু করবে। ডুমুরের তরকারিও খেতে হবে। চিকিৎসা শুরু হলে দাগের জায়গায় প্রদাহ বা জ্বালা শুরু হলে কয় দিন খাওয়া বন্ধ রাখতে হবে।
চামড়ার বিবর্ণতা : যেকোনো কারণে চামড়ার রঙ বদলে গেলে অর্থাৎ অন্য রকম হয়ে গেলে কাকডুমুর সিদ্ধ পানিতে (কাঁচা ডুমুর অথবা ছাল) ১০-১৫টি চামড়াটা ধুয়ে ফেলতে হবে। এ ছাল বা ফল থেঁতলে নিয়ে ৪ কাপ পানিতে সিদ্ধ করে ১ ভাগ থাকতে নামিয়ে ঠাণ্ডা করে ব্যবহার করতে হবে। ১৫-২০ দিন ধরে এভাবে ব্যবহার করলে রঙ স্বাভাকি হবে।
দূষিত ক্ষত : পচা বা দূষিত ঘা, তা নতুন বা পুরাতন হোক, ২০ গ্রাম কাকডুমুরের ছাল সিদ্ধ পানিতে ধুলে পচাটা সেরে যাবে। এতে ৫-৬ কাপ পানিতে ছাল নিয়ে সিদ্ধ করে এক-দেড় কাপ থাকতে নামিয়ে ব্যবহার করতে হবে
ঋতুস্রাব : মেয়েদের অতিরিক্ত ঋতুস্রাব হলে কচি ডুমুরের রস মধু মিশিয়ে খেলে উপকার পাওয়া যায়। এটি দুধ ও চিনি মিশিয়ে খেলেও চলে।
রক্তপিত্ত বা মুখ দিয়ে রক্ত ওঠা : এতে কচি ডুমুরের রসে মিছরি মিশিয়ে দিনে ২ বার করে খেতে হবে (১ চা-চামচ রসে আধা চা-চামচ মিছরির গুঁড়ো। তাতে মুখ দিয়ে রক্ত ওঠা বন্ধ হবে, এটা ৩-৪ দিন খেতে হয়।
আমাশয় : এ রোগে কাকডুমুরের পাতার একটি কুঁড়ি আতপ চালের সাথে চিবিয়ে খেলে রোগের উপশম হয়। এভাবে তিন দিন খেতে হবে। তা ছাড়া গাছের ছাল থেঁতলে নিয়ে মিছরির সরবতের সাথে ভালোভাবে চটকে ছেঁকে নেয়ার পর দিনে ২ বেলা ২ চা-চামচ করে।
মাথা ঘোরা : ভাতপাতে প্রথমে ১ চা-চামচ দূর্বাঘাস ভাজা খেয়ে পরে বীজ বাদ দিয়ে ডুমুর ভাজা খেলে উপকার হয়।
ডায়াবেটিস : কাকডুমুর গাছের শিকড়ের রস এ রোগে খুবই উপকারি। তবে অনেক দিন ধরে খেলে তবেই উপকার মিলে।
হেঁচকি : কাকডুমুর চাক চাক করে কেটে কিছুক্ষণ পানিতে ভিজিয়ে রেখে আধা ঘণ্টা পর পর ১ চা-চামচ করে তা পান করলে ৪-৫ বার পান করার পরই হেঁচকি ওঠা বন্ধ হয়।
এ ছাড়া কাকডুমুরে যথেষ্ট পরিমাণে লোহা রয়েছে বলে এটি খেলে স্কার্ভি, রক্তপ্রদর, রক্তপড়া, অর্শ্ব, রক্ত প্রস্রাব ও রক্তশূন্যতা রোগ সারে, তবে বেশি করে খেলে কোষ্ঠকাঠিন্য হয়।
যজ্ঞডুমুর : এটি উদুম্বর নামেও পরিচিত। যজ্ঞডুমুর কৃমিনাশক, সাইনাস সারায়, শোথ, রক্তদোষনাশক, ক্ষতনাশক, কুষ্ঠে কাজ দেয়। এর ক্ষীর গাঁটের ফুলোয় লাগিয়ে দিলে প্রদাহ বা জ্বালা ব্যথা কমে। নিচে যজ্ঞডুমুরের ব্যবহারবিধি দেয়া হলো।
কেটে রক্তপাত হতে থাকা : এ অবস্থায় যজ্ঞডুমুরের ঘনসার লাগালে রক্ত পড়া বন্ধ হয়ে যাবে, ব্যথা হবে না এবং ওটাতে ঘা সেরে যাবে। (ঘনসার বানানোর নিয়ম : ১২-১৫ সে.মি. ডালসহ কাঁচা পাতা ছেঁচে নিয়ে তা সিদ্ধ করে সে পানি ছেঁকে নিয়ে নরম জ্বালে আবার পাক করতে করতে ঘন হয়ে চিটাগুড়ের থেকেও একটু বেশি ঘন হলেই বা কাই করে নামাতে হয় এবং সংরক্ষণ করতে। এতে অল্প সোহাগার ঘৈ মেশালে এটা আর নষ্ট হয় না।
বিষাক্ত পোকা-মাকড়ের কামড় ও কুকুরে আঁচড় : এ অবস্থায় যজ্ঞডুমুরের ঘনসার লাগালে জ্বালা-যন্ত্রণার উপশম হবে, বিষও থাকবে না।
থেতলে যাওয়া ও আঘাত লাগা : এ অবস্থায় ঘনসারের সাথে দুই গুণ পানি মিশিয়ে পেস্ট বা লেইয়ের মতো লাগালে ফুলা ও ব্যথা দুই-ই কমে যাবে।
ফোঁড়া : ফোঁড়ায় ঘনসার চার গুণ পানির সাথে মিশিয়ে ন্যাকড়া বা তুলোয় লাগিয়ে বসিয়ে দিলে ওটা ফেটে পুঁজ রক্ত বেরিয়ে যাবে এবং ক’দিনেই তা সেরে যাবে।
মুখের দুর্গন্ধ, দাঁতের ও মুখে ক্ষত : এ অবস্থায় যজ্ঞডুমুরের ঘনসার আট গুণ পানিতে গুলে গরগরা করলে অথবা মুখে রেখে দিলে দু-এক দিনেই রোগের উপশম হবে।
গ্রন্থিস্ফীতি : যজ্ঞডুমুরের ক্ষীর ফোলায় লাগালে প্রদাহ ও ব্যথা কমে যায়, বসেও যায়।
রক্তপিত্ত, রক্তার্শ ও রক্তস্রাব : যজ্ঞডুমুরের ঘনসার ১২ গ্রেন আন্দাজ নিয়ে ৫০ মিলিলিটার পানিতে মিশিয়ে দিনে ২-৩ বার খেলে রোগের উপশম হয়।
পিত্তবিকারজনিত রোগ : এ ক্ষেত্রে যজ্ঞডুমুরের শুকনো পাতার গুঁড়ো মধুর সাথে মিশিয়ে খেলে সেরে যায়।
চিকেন পক্স : এসব ক্ষেত্রে পাতা দুধে ভিজিয়ে মধুতে মেড়ে লাগালে বিশেষ উপকার হয়।
স্ত্রী রোগজনিত স্রাব : এ ক্ষেত্রে ঘনসার ৮-১২ গুণ পানিতে গুলে ডোস দিলে তা নিশ্চিত প্রশমিত হবে।
প্রদর : যজ্ঞডুমুরের রক্ত মধুর সাথে মিশিয়ে খেলে প্রদর রোগ সারে।
বহুমূত্র : দাদখানি চালের সাথে যজ্ঞডুমুরের ভর্তা খেলে বহুমূত্র রোগে উপকার হয়
যজ্ঞডুমুরে অনেক উপকারিতা থাকা সত্ত্বেও এতে লোহা বেশি বলে অধিক পরিমাণে খেলে কোষ্ঠকাঠিন্য হতে পারে। এতে প্রতিদিন সকালে খালি পেটে এক গ্লাস পানিতে একটি পাতি লেবুর রস মিশিয়ে পান করলে অসুবিধাটা চলে যাবে