ভাইরাল হেপাটাইটিসের চিকিৎসা
হেপাটাইটিস ‘সি’, হেপাটাইটিস ‘ডি’ এবং হেপাটাইটিস ‘ই’ ভাইরাস। তন্মধ্যে ‘এ’ এবং ‘ই’ ভাইরাস সাধারণত স্বল্প মেয়াদী লিভার প্রদাহ করে। এরা দূষিত পানি ও খাবারের মাধ্যমে ছড়ায়। ‘বি’, ‘ডি’ ও ‘সি’ ভাইরাস সাধাণত দীর্ঘ মেয়াদী লিভার প্রদাহ করে। এরা ছড়ায় দূষিত রক্ত গ্রহণ, দূষিত সিরিঞ্জ ব্যবহার, নাপিত কর্তৃক ক্ষুরে দূষিত ব্লেড ব্যবহার, অপরিশোধিত যন্ত্রপাতি দিয়ে অস্ত্রপ্রচার, আক্রান্ত মা থেকে শিশুকে এবং আনপ্রোটেক্টড সেক্স-এর মাধ্যমে।
বিশ্বে একিউট ভাইরাল হেপাটাটিস-এর আক্রান্ত রোগীদের ৩০ শতাংশ-এর রক্তে হেপাটাইটিস ‘এ’ ভাইরাস পাওয়া যায় এবং আক্রান্ত শিশুদের ক্ষেত্রে তা প্রায় ৯০ শতাংশ। প্রতি বছর ২ কোটি মানুষ হেপাটাইটিস ‘ই’ ভাইরাস দ্বারা আক্রান্ত হয়। এর মধ্যে প্রায় ৩৩ লক্ষ রোগীর লিভার প্রদাহজনিত লক্ষণ দেখা দেয় এবং প্রায় ৫৬ হাজার ব্যক্তি হেপাটাইটিস ‘ই’ জনিত ফালমিনেন্ট হেপাটিক ফেইলিওর হয়ে মৃত্যুবরণ করে।
বিভিন্ন গবেষণায় দেখা যায়, বাংলাদেশের প্রায় ০.২ থেকে ১ শতাংশ মানুষ তাদের লিভারে হেপাটাইটিস ‘সি’ ভাইরাস বহন করছে। উল্লেখ্য, হেপাটাইটিস ‘বি’ এবং ‘সি’ ভাইরাস আমাদের দেশে যথাক্রমে ৬০ ও ৩০ শতাংশ লিভার সিরোসিস এবং যথাক্রমে ৬৪ ও ১৭ শতাংশ হেপাটোসেলুলার কারসিনোমা (লিভার ক্যান্সার)-এর রোগীর জন্য দায়ী। একিউট ভাইরাল হেপাটাইটিস বা স্বল্পমেয়াদী লিভার প্রদাহের প্রধান লক্ষণগুলো হলো— জন্ডিস, খাবারে অরুচি, উপরের পেটের ডান দিকে বা মাঝখানে ব্যথা, বমি বমি ভাব ও বমি, দুর্বলতা ও জ্বর।
অন্যদিকে ক্রনিক ভাইরাল হেপাটাইটিস তথা দীর্ঘ মেয়াদী লিভার প্রদাহে ভাইরাস সুপ্ত অবস্থায় লিভারের কোষে বংশবৃদ্ধি করতে থাকে। ফলে কোনো সুস্পষ্ট লক্ষণ পাওয়া যায় না। কারও কারও ক্ষেত্রে দুর্বলতা, ক্ষুধামন্দা ও পেটে হালকা ব্যথা অনুভূত হতে পারে। কিন্তু যাদের ক্রনিক ভাইরাল হেপাটাইটিস থেকে লিভার সিরোসিস হয়ে যায় তাদের ক্ষুধামন্দা, পেটের অসুখ, শরীর শুকিয়ে যাওয়া, জন্ডিস, পেটে পানি আসা ও চেতনালোপ জাতীয় লক্ষণ দেখা দেয়।
হেপাটাইটিস ‘বি’ ও ‘সি’ ভাইরাস জনিত দীর্ঘমেয়াদি লিভার রোগের চিকিত্সায় চিকিত্সাবিজ্ঞান প্রভূত উন্নতি সাধন করেছে। হেপাটাইটিস ‘বি’ ভাইরাসের চিকিত্সায় প্রথম আবিষ্কার হয় ইন্টারফেরন নামক ইঞ্জেকশন। পরবর্তীতে পর্যায়ক্রমে বেশ কয়েকটি মুখে খাওয়ার ওষুধ আবিষ্কার হয় যা এখন সর্বত্র পাওয়া যাচ্ছে। হেপাটাইটিস ‘সি’ ভাইরাসের চিকিত্সায় আগে শুধু ইন্টারফেরন ব্যবহার করা হত। তবে ২০১৫ সাল থেকে অনেকগুলো নতুন এন্টিভাইরাল ওষুধ বাজারজাত হওয়ায় অনুমতি পেয়েছে যেগুলো মুখে সেবন করা যায় এবং যার সাফল্যের হার প্রায় ৯০ শতাংশ। আমাদের জন্য খুশির খবর হল বাংলাদেশে হেপাটাইটিস ‘বি’ ও ‘সি’ ভাইরাসের চিকিত্সায় ব্যবহূত সবগুলো ওষুধ কার্যকর।
লিভার রোগের চিকিত্সায় ব্যবহূত ওষুধগুলোর গুণগত মান নিশ্চিত রাখা সকল শ্রেণির মানুষের ক্রয় ক্ষমতার মধ্যে আনার চেষ্টা করা এবং হেপাটাইটিস প্রতিরোধকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে নিম্নোক্ত পদক্ষেপ গ্রহণ: জনসচেতনতা তৈরি, হেপাটাইটিস ‘এ’ ও ‘ই’ প্রতিরোধে বিশুদ্ধ পানি ও খাবারের নিশ্চয়তা প্রদান, যে বিশাল সংখ্যক জনগোষ্ঠী এখনো হেপাটাইটিস ‘বি’ ভাইরাসের টিকা নেয়নি তাদেরকে টিকা দেয়ার পদক্ষেপ হিসেবে প্রাথমিকভাবে যারা বেশি ঝুঁকিপূর্ণ যেমন: স্বাস্থ্যসেবায় নিয়োজিত চিকিত্সক, সেবিকা ও হেলথ টেকনেসিয়ানদের টিকা দেয়া নিশ্চিত করা।
২০০৩ সালের পূর্বে জন্মগ্রহণকারী শিশুদের টিকার আওতায় আনার জন্য স্কুলের সেকেন্ডারি লেভেল থেকে শুরু করে ইউনিভার্সিটি পর্যন্ত হেপাটাইটিস ‘বি’ স্ক্রিনিং প্রোগ্রাম আয়োজন করার মাধ্যমে যাদের শরীরে হেপাটাইটিস বি নেই এবং বি ভাইরাসে বিপরীতে এন্টিবডিও নেই তাদের বি ভাইরাসের টিকা দেয়ার ব্যবস্থা করা এবং এজন্য প্রয়োজন বিভিন্ন এনজিওর সহযোগিতা নেওয়া।