ফিস্টুলার অবসানে নিশ্চিত হোক নারীর সম্মান
বাংলাদেশে আড়াই দশকেরও বেশি সময় ধরে রাষ্ট্র ও রাজনৈতিক দলের চালকের আসনে নারী। দেশের প্রধানমন্ত্রী, প্রধান বিরোধী দলের নেতা ও জাতীয় সংসদের স্পিকার নারী। জাতীয় সংসদে নারীদের জন্য ৫০টি আসন আছে। দেশের মুক্তিযুদ্ধ থেকে শুরু করে সর্বক্ষেত্রে নারীর ভূমিকা ছিল সব সময়। বাংলাদেশের নারীরা উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জন করেছেন। এসব অর্জন আমাদের আশাবাদী করে।
বাংলার নারীর অবদান অনস্বীকার্য, সাহিত্য সংস্কৃতি ঘরে-বাইরে সর্বক্ষেত্রে নারীদের ভূমিকা খুব একটা পিছিয়ে নেই। তারপরও নারীরা অনেক বিষয়েই অজ্ঞ। নারীর ৩টি রূপ থাকে। কখনো কন্যা কখনো জায়া, আবার কখনো জননী। একজন নারী বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার পর সন্তান প্রসবের সময় বা পরে জটিল রোগে আক্রান্ত হন। বিভিন্ন সময় দেখা যায়- লোকলজ্জার ভয়ে ওই মা তখন কাউকে কিছুই বলতে পারেন না, এতে করে ধীরে ধীরে তাকে হয়তো প্রিয় স্বামীটিও ত্যাগ করেন। তখন আমাদের কি কিছুই করার থাকে না?
গ্রাম-বাংলার আনাচে-কানাচে এখন এ রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন অনেক মা-বোন। অজ্ঞতার কারণে একজন মাকে তিলে তিলে গিলে খায় যে রোগটি তার নাম ‘ফিস্টুলা’। প্রসবের সময় বাচ্চার মাথা মায়ের প্রসব রাস্তার নরম অঙ্গসমূহকে চাপ দিয়ে রাখে। বাচ্চার মাথার এই চাপের ফলে মায়ের নরম অঙ্গ সমূহের রক্ত সঞ্চালন বাধাগ্রস্ত বা বন্ধ হয়ে যায়।
যদি ১২ ঘণ্টার বেশি দীর্ঘস্থায়ী হয় তবে সেই চাপে পড়া অঙ্গে পচন ধরে। ফলে মাসিকের রাস্তার সঙ্গে মূত্রথলি বা পায়খানার রাস্তায় এক বা একাধিক ছিদ্র তৈরি হয়। এবং অনবরত পায়খানা বা প্রস্রাব ঝরতে থাকে। বর্তমানে সারাবিশ্বে ১০ লাখ মা ফিস্টুলা রোগে ভুগছেন। আর এতে প্রতিবছর আরও যোগ হচ্ছে প্রায় ৫০ হাজার রোগী। এদিকে বাংলাদেশে প্রায় ২০ হাজার নারী ফিস্টুলা রোগে ভুগছেন। আর প্রতিবছর যোগ হচ্ছে আরো এক হাজার রোগী।
আক্রান্ত নারীর শরীর থেকে প্রস্রাব, পায়খানার দুর্গন্ধ ছড়াতে থাকে। যার ফলে পরিবার তাকে আলাদা ঘরে রাখে। এক সময় এ নারী মানসিক রোগীতে পরিণত হয়, ফলে অনেকেই আত্মহত্যার পথ বেছে নেন। কিন্তু একটু সচেতন হলে এই রোগ থেকে পরিত্রাণ পাওয়া যায়। প্রসবজনিত ফিস্টুলা বাংলাদেশে একটি অন্যতম নারী স্বাস্থ্য সমস্যা। বাধাগ্রস্ত প্রসবের ফলে সময় মতো পর্যাপ্ত চিকিৎসার অভাবে সাধারণত প্রসবজনিত ফিস্টুলা হয়ে থাকে। কোনো কোনো সময় সিজারিয়ান সেকশন অপারেশন, জরায়ু অপসারণের অপারেশন এবং ল্যাপারোস্কপিক অপারেশনের পরেও ফিস্টুলা হতে পারে। কোনো কোনো প্রসবের সময় যোনিপথ ছিঁড়ে গিয়ে পায়ুপথের সঙ্গে মিশে যায়। এই সকল ক্ষেত্রে আক্রান্ত নারীদের সন্তান প্রসবের রাস্তা দিয়ে সব সময় প্রস্রাব বা কখনো পায়খানা ঝরতে থাকে।
এই সমস্ত সমস্যাগুলো প্রসবজনিত ফিস্টুলা কর্মসূচির আওতায় চিকিৎসা, প্রতিকার, প্রতিরোধ ও প্রশিক্ষণ ইত্যাদির জন্য কাজ করছে ইউনিভার্সিটি ফিস্টুলা সেন্টার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় মাম্স ইনস্টিটিউট অফ ফিস্টুলা অ্যান্ড হেলথ। ফিস্টুলা আক্রান্ত রোগীরা সাধারণত খুবই অসহায় ও করুণ জীবনযাপন করেন। তাই এই রোগীদের সম্পূর্ণ বিনামূল্যে ভর্তি চিকিৎসা অপারেশন, ওষুধ ইত্যাদি দেয়া হয়। শুধু চিকিৎসা নয় রোগী ও তার সঙ্গীর যাতায়াত খরচও কেন্দ্রের নিয়ম অনুযায়ী প্রদান করা হয়ে থাকে।
ফিস্টুলা থেকে প্রতিকার
ফিস্টুলা থেকে প্রতিকারের উপায় হলো ১৮ বছরের কম বয়সী মেয়েকে বিয়ে দেবেন না। কিশোরী বয়সে সন্তান জন্মদান থেকে বিরত থাকুন। সঠিক বয়সে প্রসূতি মাকে স্বাস্থ্য কেন্দ্রে নিয়ে যান ইত্যাদি। ফিস্টুলা রোগের ফলে নারীরা স্বামী পরিত্যক্তা হয়, বিষণ্নতায় ভোগে এতে করে আত্মহত্যার প্রবণতা বাড়ে। নারীর সম্মান নারীকে ফিরিয়ে দিতে সচেতন হতে হবে পরিবারকে। আর নয় লোকলজ্জা, যেতে হবে স্বাস্থ্যকেন্দ্রে। নারী জাতিকে অবহেলা করলে আমাদের সমাজ, দেশ, জাতি বাধাগ্রস্ত হবে। একজন ভালো সুস্থ মা দেশ জাতি গঠনে একটি বড় ভূমিকা রাখতে পারেন।
চিকিৎসায় কত সময় লাগে
এটি নির্ভর করে ফিস্টুলার ধরণ ও জটিলতার ওপর। সাধারণত সার্জারি বা অপারেশনের ক্ষেত্রে ৪ সপ্তাহ হাসপাতালে থাকা লাগতে পারে।
চিকিৎসার খরচ
সরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে বিনামূল্যে চিকিৎসা সেবা দেয়া হয়। ফিস্টুলা কেয়ার প্লাস সার্পোটেড হাসপাতালগুলোতে বিশেষ করে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়, কুমুদিনী হাসপাতাল, ল্যাম্ব হাসপাতাল, আদ-দ্বীন হাসপাতাল, ডা. মুত্তালিব হাসপাতাল, মামস হাসপাতালে এর সেবা দেয়া হয়। এ ছাড়াও যাতায়াত, সঙ্গীর জন্য খরচসহ সমুদয় চিকিৎসা খরচ নির্বাহ করা হয়।