মৃত্যু থেকে কবরে নামানোর আগ পর্যন্ত লাশের সাথে ফেরেস্তারা যা করে থাকেন!
আজরাঈল যখন আত্মা কবজ করে নেন, তখন আত্মা দেহকে বলে, হে দেহ! আল্লাহ তোমাকে সুপ্রতিদান দিক। তুমি আমার সঙ্গী হয়ে আল্লাহর আনুগত্যে অগ্রগামী ছিলে। আর আল্লাহর অবাধ্যে ছিলে খুবই পশ্চাৎপদ। তুমি আমার পক্ষ থেকে মুবারকবাদ গ্রহণ কর। কেননা আজ তুমি নিজেও মুক্তি পেয়েছো আর আমাকেও নাজাত দিয়েছ। এভাবে দেহও আত্মাকে মুবারকবাদ দেয়। মুমিন বান্দার মৃত্যুতে যমীনের যে সকল অংশে সে ইবাদত করত সেগুলো কাঁদতে থাকে। আকাশের যে সকল দুয়ার দিয়ে তার নেক আমল উপরে উঠত সে সকল দুয়ার তার জন্যে কাঁদতে থাকে। যে দরজা দিয়ে তার রিযিক নেমে আসত সে দরজাও কাঁদতে থাকে।
আকাশ যমীনের এ ক্রন্দন দীর্ঘ চল্লিশ দিন পর্যন্ত অব্যাহত থাকে। মালাকুল মউত যখন তার আত্মা কবজ করে নেয় তখন তার দেহের হেফাযতের জন্যে সেখানে পাঁচশত ফেরেশতা দাঁড়িয়ে থাকে। যদি কেউ তার লাশের পাশ ফিরাতে চায় তখন ফিরিশতারাও এ কাজে মানুষের সহযোগিতা করে। এমনকি কাফন পরিধান ও সুগন্ধি মাখানোর কাজেও ফিরিশতারা অংশ নেয়। লাশের সম্মানার্থে ফিরিশতারা দুটি সারি করে ঘর থেকে কবর পর্যন্ত দাঁড়িয়ে যায়। জানাযা যখন অতিক্রম করে তখন তারা অভ্যর্থনা জানায়। তার জন্যে ক্ষমার প্রার্থনা করে। মুমিনের মর্যাদার এ অবস্থা দেখে ইবলিশ এত জোরে চিৎকার করে উঠে যে, তার দেহের হাড়ের কোন কোন গ্রন্থির বন্ধন এ সময় ছিঁড়ে যায়। সে আক্ষেপের সাথে তার সঙ্গীদের বলতে থাকে তোমাদের সর্বনাশ হোক। এই বান্দা তোমাদের ফাঁদ থেকে কিভাবে ফসকে গেল। ইবলিশের সঙ্গীরা বলে, এ নিষ্পাপ ছিল তাই আমাদের ফাঁদে আটকায়নি।
মালাকুল মউত যখন তার আত্মাকে নিয়ে আকাশে আরোহন করে তখন হযরত জিবরাইল (আ) সত্তর হাজার ফিরিশিতা নিয়ে তাকে অভ্যর্থনা জানায়। আর সকল ফিরিশতারা তার নিকট আল্লাহ তায়ালার সন্তুষ্টির সুসংবাদ জানাতে থাকে। মালাকুল মউত যখন আত্মাটিকে নিয়ে আরশের নিকট পৌঁছেন তখন সে আল্লাহ তায়ালার সামনে সিজদায় পতিত হয় যায়। আর সে সময় আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন, হে মালাকুল মউত! তুমি আমার বান্দাকে নিয়ে জান্নাতের বাগানে রেখে এস। অতঃপর তাকে কবরে রাখার পর নামায তার ডান দিকে এবং রোযা তার বামদিকে এসে দাঁড়িয়ে যায়। আল্লাহর যিকর ও কুরআন তিলাওয়াত এসে দাঁড়িয়ে যায় তার শিথানের দিকে। পায়ের দিকে দাঁড়িয়ে যায় জামাতের সাথে নামায পড়ার জন্য মসজিদের দিকে গমন। আর তার ধৈর্য্য কবরের এক কোনায় অবস্থান নেয়। এ সময় আল্লাহ তায়ালা তার কবরে আযাবের একটি অংশ প্রেরণ করেন। আযাবটি এসে কবরে ডানদিকে থেকে প্রবেশ করতে চায়। কিন্তু নামায তাকে বাধা দিয়ে বলে- আযাব তুমি পিছিয়ে যাও। খোদার কসম! এই বান্দাটি সারা জীবন কষ্টে ছিল। কবরে আসার পর তার কিছুটা আরাম মিলেছে।
রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ফরমান, আযাব তখন ডান দিকে থেকে সরে বাম দিকে যায়। বাম দিকে রোযা নামাযের মত আযাবকে জবাব দিয়ে প্রতিহত করে।আযাব এবার মাথার দিক থেকে আসতে চেষ্টা করলেও একই রকম জবাব আসে। মোট কথা আযাব যেদিক থেকেই আসতে চায় সেদিক থেকেই তার জন্যে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হয়। অবশেষে আযাব যখন দেখে আল্লাহর এই নেক বান্দার আমল সব দিক থেকেই তার জন্যে প্রতিরক্ষার দেয়াল সৃষ্টি করে রেখেছে তখন সে ফিরে যায়। আর সে সময় ‘সবর’ উঠে নেক আমল সমূহকে বলতে থাকে, এই আযাবের প্রতিরক্ষায় আমি এজন্যে আসিনি যে মূলত তোমাদের শক্তির পরিমাণ দেখা আমার উদ্দেশ্য ছিল। তোমরা যদি তাকে প্রতিহত করতে ব্যর্থ হতে তাহলে আমি অবশ্যই এসে এই বান্দাকে আযাব থেকে রক্ষা করতাম। তোমরাই যখন যথেষ্ট হয়ে দাঁড়ালে তখন আমি এই বান্দার জন্যে অতিরিক্ত সঞ্চয় হয়ে রয়ে গেলাম। পুলসিরাত আর মিযানে আমি তার কাজে আসব।
এরপর ঐ বান্দার নিকট এমন দুজন ফিরিশতা আসে যাদের চোখ নীল বর্ণের। আওয়াজ ভয়ংকর। গরুর শিংগের ন্যায় দাঁত এবং তাদের শ্বাসের সাথে নাসা রন্ধ্র দিয়ে অগ্নি শিখা বের হয়। ফিরিশতাদ্বয়ের উভয় কাঁধের মধ্যবর্তীস্থান খুবই প্রশস্ত। তারা মুমিন বান্দা ছাড়া আর কারো উপর দয়া করতে জানে না। এই দুজন ফিরিশতাদেরকেই মুনকার নাকির বলা হয়। ওদের হাতে একটি হাতুড়ি থাকে। এটি এতই ভারি যে সকল মানব-দানব মিলে একত্রিত হলেও তা উত্তোলন করতে সক্ষম হবে না। এ দুজন ফিরিশতা কবরে প্রবেশ করে লাশকে বলে উঠে বসো। লাশ তৎক্ষণাৎ উঠে বসে যায় এবং কাফনের কাপড় খুলে পড়ে যায়। ফিরিশতা তখন জিজ্ঞেস করেন, তোমার প্রভূ কে? তোমার ধর্ম কি ? এবং তোমার নবী কে? জবাবে সে বলে, আমার রব হলেন আল্লাহ যার কোন অংশীদার নেই। আমার ধর্ম ইসলাম। আর হযরত মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) হলেন আমার নবী। তারপর আর কোন নবীর আগমন হবে না।
ফিরিশতা জবাব শুনে বলেন, তুমি সত্য বলেছ। অতপর কবরকে চারদিকে থেকে প্রশস্ত করে বলেন , তুমি উপরের একটু দিকে তাকিয়ে দেখ। সে উপরে তাকায়। তখন আকাশের শেষ সীমানাতক তার চোখের সামনে ভেসে উঠে। ফিরিশতারা বলেন, হে আল্লাহর বন্ধু ! এটা তোমার অবস্থানের ঠিকানা। আল্লাহর আনুগত্যের বিনিময়ে তুমি এটা পেয়েছ। বর্ণনার এই পর্যায়ে এসে রাসুল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ) বলেন, ওই সত্তার কসম যার মুঠোয় আমার প্রাণ। মুমিন বান্দার তখন এতই আনন্দ অনুভূত হয় যা কখনো শেষ হবার নয়। অতঃপর ঐ বান্দাকে আবার নির্দেশ দিয়ে বলা হয় যে, তুমি নিচের দিকে দেখ। নিচের দিকে যখন সে তাকায় তখন দোযখের শেষ সীমানা পর্যন্ত তার দৃষ্টির গোচরে চলে আসে। ফিরিশতা তখন তাকে বলে, হে আল্লাহর প্রিয় পাত্র ! এই ভয়াবহ নরক থেকে তুমি নাযাত পেয়েছ।
রাসুল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ইরশাদ করেন, ওই বান্দার এ সময় এমন পুলকানুভূতি অর্জিত হয় যা কখনো সমাপ্ত হবার নয়। অতঃপর স্বর্গের সাতাত্তরটি দরজা তার জন্যে উন্মুক্ত করে দেয়া হয়। এসব দুয়ার দিয়ে জান্নাতের সৌরভ এবং সুশীতল সমীরণ তার কবরে পৌঁছতে থাকে এবং ততদিন পৌঁছতে থাকবে যতদিন সে কবরে থাকবে।
রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আলোচনার ধারাবাহিকতা অব্যাহত রেখে বলেন, এরপর আল্লাহ তায়ালা মালাকুল মউতকে নির্দেশ দিয়ে বলেন, তুমি আমার দুশমনের নিকট যাও এবং তাকে আমার কাছে নিয়ে এসো। আমি প্রাচুর্য্যের সাথে তাকে রুযি দিয়েছি। সীমাহীন নিয়ামতের বারিপাত করেছি তার উপর। কিন্তু সে আমার সাথে শুধু অবাধ্যতাই করে ফিরেছে। এবার এই দুশমনকে আমার কাছে হাজির করো।
মালাকুল মউত আল্লাহর নির্দেশ পেয়ে এমন কদাকার বেশে ঐ বান্দার নিকট আগমন করে যে, কেউ কোনো দিন এমন আকৃতি দেখেনি। তার বারটি চোখ থাকে। তার কাছে এমন একটি লৌহ শলাকা থাকে যা শাখা ও কাঁটা বিশিষ্ট। মালাকুল মউতের সাথে আরো পাঁচশত ফিরিশতা থাকে। এদের প্রত্যেকের সাথেই থাকে জাহান্নাম থেকে নিয়ে আসা আগুনের চাবুক। মালাকুল মউত অবাধ্য বান্দাকে চাবুক দিয়ে এমনভাবে আঘাত করে যে, প্রতিটি কাঁটা তার সারা দেহে তন্ত্রের মূলে বিদ্ধ হয়ে যায়। অতঃপর সেটি পাকিয়ে টেনে বের করে এবং তার পায়ের নখের তলদেশ থেকে পর্যন্ত আত্মাকে বের করে নিয়ে আসে। এরপর সেই লৌহ শলাকাটি তার উভয় পায়ের গোড়ালিতে ঢুকিয়ে দেয়া হয়।
তখন আল্লাহর এই দুশমনের এতই কষ্ট হয় যে , বেদনায় সে কাতরাতে থাকে। এমন সময় বাকি ফিরিশতারা তাদের হাতের চাবুক দিয়ে তার মুখমন্ডল এবং পশ্চাৎদেশে অনবরত প্রহার করতে থাকে। এ সময় তার আত্মাকে টেনে সারা দেহ থেকে গোড়ালিতে নিয়ে আসা হয়। শাস্তির এই পর্যায়ে শলাকাটি তার হাঁটুতে ফোটানো হয়। তখন বেদনায় সে ছটফট করতে থাকে। এমন সময় ফিরিশতারা আবার আগুনের চাবুক দিয়ে তার মুখ ও নিতম্বে মারতে শুরু করে। হাঁটু থেকে শলাকাটি বের করে ঢুকানো হয় তার নিতম্ব দেশে। অতঃপর বুকে এবং সব শেষে কন্ঠনালীতে, তারপর পূর্বের মতই সেটিকে টেনে বের করা হয়। এরপর ফিরিশতারা জাহান্নাম থেকে সংগ্রহ করা অঙ্গার তার থুতনীর নিচে বিছিয়ে দিয়ে বলে, হে অপবিত্র আত্মা ! তুমি বেরিয়ে আস। “তুমি থাকবে প্রখর বাষ্পে, উত্তপ্ত পানিতে, এবং ধুম্রকুঞ্জের ছায়ায়। যা শীতল নয় এবং আরামদায়কও নয়”। (সূরা ওয়াকেয়া ৪২-৪৪) (মুসনাদে আবি ইয়ালা, ইবন আবি দুনিয়া)