লিঙ্গ পরিচয় বুঝতে বিজ্ঞান কীভাবে আমাদের সহায়তা করছে
নারী এবং পুরুষের দ্বিবিভাজন থেকে বেরিয়ে এসে লিঙ্গ পরিচয় এখন নতুন রূপ ধারন করছে। বিজ্ঞান কি এ ক্ষেত্রে আমাদের কোনো সহায়তা করতে পারে?
ফেসবুক প্রোফাইলে লিঙ্গ পরিচয়ের ক্ষেত্রে মেল, ফিমেল, ট্রান্সজেন্ডার, সিসজেন্ডার, জেন্ডার ননকনফর্মিং, জেন্ডারকুইয়ার, অ্যাজেন্ডারসহ মোট ৫০টি পরিভাষা যুক্ত করা হয়েছে।
পাশাপাশি বিজ্ঞানীরাও লিঙ্গ পরিচয়ের জৈবিক বুঝ সংক্রান্ত নতুন নতুন জটিলতা উদঘাটন করে চলেছেন।
আমাদের অনেকেই উচ্চ বিদ্যালয়ের জীববিজ্ঞানে শিখেছি সেক্স ক্রোমোজম কোনো মানবশিশুর লিঙ্গ নির্ধারণ করে। এক্সএক্স ক্রোমোজম নিয়ে জন্মানো শিশু হলো মেয়ে। আর এক্সওয়াই মানে হলো ছেলে। কিন্তু অনেক সময় শুধু এক্সএক্স এবং এক্সওয়াই পুরো গল্প বলে না।
আমরা এখন জানি লিঙ্গীয় বৈশিষ্ট্যের যে নানা উপাদানকে আমরা ‘পুরুষ’ ও ‘নারী’ বলে বিবেচনা করি সেগুলো সব সময় পরিচ্ছন্নভাবে জোট বাঁধে না। একদিকে এক্সএক্স- ডিম্বাশয়, নারী জননাঙ্গ, এস্ট্রোজেন, নারী লিঙ্গ পরিচয় এবং নারী সুলভ আচরণ। অন্যদিকে, এক্সওয়াই- অণ্ডকোষ, পুরুষাঙ্গ, টেস্টোস্টেরন, পুরুষ লিঙ্গ পরিচয় এবং পুরষালি ব্যবহার। কিন্তু এক্সএক্স ক্রোমোজমধারী হওয়া সত্ত্বেও দৈহিক গঠনতন্ত্র, শারীরবৃত্তিক এবং মনোস্তাত্বিকভাবে প্রায় পুরোপুরি পুরুষ হওয়া সম্ভব। আবার এক্সওয়াই ক্রোমোজমধারী হওয়া সত্ত্বেও একইভাবে প্রায় পুরোপুরি নারী হওয়া সম্ভব।
ডিম্বাশয়ে প্রতিটি ভ্রুণই নারী-পুরুষ উভয় বৈশিষ্ট্য নিয়ে যাত্রা শুরু করে। যা ছয় থেকে আট সপ্তাহের মধ্যে নারী বা পুরুষ হিসেবে রূপ ধারণ করে।
লিঙ্গ ভিন্নতা সূচিত হয় মূলত ওয়াই ক্রোমোজোমের একটি জিনের মাধ্যমে। এর নাম এসআরওয়াই জিন। এই জিন নারী-পুরুষ উভয় বৈশিষ্ট্য নিয়ে যাত্রা শুরু করা ভ্রুণে শুক্রাশয় সৃষ্টি করে। আর সেই শুক্রাশয় থেকে টেস্টোস্টেরন এবং অন্যান্য পুরষালি হরমোন নিঃসৃত হয়। সামষ্টিকভাবে এগুলোকে বলা হয় এন্ড্রোজেন। এরপর ভ্রুণে একটি প্রস্টেট, অণ্ডকোষ এবং পুরুষাঙ্গ সৃষ্টি হয়।
এসআরওয়াই জিন ছাড়া আদি ভ্রুণটি ছয় থেকে আট সপ্তাহের মধ্যে ডিম্বাশয়ে রুপ নেয়। যা থেকে এস্ট্রোজেন হরমোন নিঃসৃত হয়। আর ভ্রুণটিতে নারীর শারীরিক বৈশিষ্ট্যগুলো সৃষ্টি হয়- জরায়ু, নারী জননাঙ্গ এবং ভগাঙ্কুর।
কিন্তু এসআরওয়াই জিনের কার্যক্রম সব সময় সোজাসাপ্টাভাবে সম্পন্ন হয় না। ফলে অনেক এক্সওয়াই ক্রোমোজমধারী ভ্রুণেও পুরুষ লিঙ্গের শারীরিক বৈশিষ্ট্যগুলোর সৃষ্টি হয় না। এবং জন্মের সময় তা মেয়ে হিসেবে চিহ্নিত হয়।
আবার এক্সএক্স ক্রোমোজমধারী ভ্রুণেও এসআরওয়াই জিন সক্রিয় হতে পারে। যার ফলে এতে নারীর অঙ্গ প্রত্যঙ্গ সৃষ্টি না হয়ে পুরুষ লিঙ্গের শারীরিক বৈশিষ্ট্যগুলো সৃষ্টি হতে পারে। এবং জন্মের সময় তা ছেলে হিসেবে চিহ্নিত হতে পারে।
এসআরওয়াই জিনের সংশ্লিষ্টতা ছাড়াও জিনগত ভিন্নতা ঘটতে পারে। এমন একটি অবস্থার নাম কমপ্লিট অ্যান্ড্রোজেন ইনসেনসিটিভিটি সিন্ড্রোম (সিএআইএস)। এই অবস্থাতে একটি এক্সওয়াই ক্রোমোজমধারী ভ্রুণ পুরষালি হরমোনগুলোর প্রতি কোনো সাড়া দেয় না। এমনকি ভ্রুণটিতে শুক্রাশয় সৃষ্টি এবং পুরুষালি হরমোন নিঃসৃত হওয়া সত্ত্বেও পুরুষাঙ্গ সৃষ্টি হয় না। ফলে শিশুটি একটি নারী জননাঙ্গ এবং ভগাঙ্কুর নিয়ে জন্ম গ্রহণ করে। এবং বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই নিজেকে নারী হিসেবে অনুভব করে।
তাহলে পুরুষের শুক্রাশয় আর নারীর জননাঙ্গ নিয়ে জন্মানো নিয়ে এই শিশুকে কী বলব আমরা? সে কি নারী যেমনটা সে নিজেকে অনুভব করে? নাকি এক্সওয়াই ক্রোমোজমধারী হওয়া এবং তলপেটে পুরুষের একটি শুক্রাশয় থাকার কারণে তাকে পুরুষ বলা হবে?
জর্জিয়ার ডেভিস (৩৫) এই সিএআইএস সমস্যা নিয়ে জন্ম গ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু ২০ বছর বয়স পর্যন্ত তিনি তা জানতেন না। তিনি নিজেকে নারী মনে করা সত্ত্বেও কেউ তাকে ২০ বছর বয়সের আগে তিনি যে পুরুষ ক্রোমোজম এক্সওয়াই ধারন করছেন তা বলেনি। এমনকি ডাক্তাররাও ১৩ বছর বয়সে তার এই সমস্যা শনাক্ত করেন। এরপর ১৭ বছর বয়সে অপারেশন করে তার শুক্রাশয়টি অপসারণ করা হয়। সে সময় তাকে বলা হয় ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি থাকার কারণে তার ডিম্বাশয়টি অপসারণ করা হচ্ছে। অথচ তার কোনো ডিম্বাশয় ছিল না। সেটি ছিল শুক্রাশয় যা পুরুষদের অণ্ডকোষে থাকে।
তার লিঙ্গ পরিচয়ে বলা যায় ইন্টারসেক্স বা উভলিঙ্গ। অর্থাৎ নারী ও পুরুষের মাঝামাঝি অবস্থা।
ডেভিস এখন লাস ভেগাসের নেভাদা বিশ্ববিদ্যালয়ে একজন সমাজবিজ্ঞানী হিসেবে কর্মরত আছেন। তিনি তার লিঙ্গ পরিচয় নিয়ে ‘কনটেস্টিং ইন্টারসেক্স : দ্য ডিউবিয়াস ডায়াগনোসিস’ শিরোনামে একটি বই লিখেছেন। সেখানে তিনি প্রশ্ন তুলেছেন যে, ‘তার লিঙ্গ পরিচয় কী এতটাই ঘৃণ্য যে তার বাবা-মাও তাকে সত্য বলেননি’।