অন্ধ বিশ্বাস আর কু-সংস্কারের বিষবাষ্প ছড়িয়ে আছে আমাদের সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে। এর ফায়দা লোটে একশ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী। সেই পুরাকাল থেকে আজ পর্যন্ত তান্ত্রিক, সাধু, পীর, ফকিরের, হেকিম, কবিরাজ, হকার থেকে শুরু করে স্যুট-টাই পরা আধুনিক চিকিৎসকের বেশ ধরে এরা ঘুণপোকার মতো কুরে কুরে খাচ্ছে আমাদের সমাজের মেরুদণ্ডকে।

তাই আজ পর্যন্ত নিজের পায়ে ঠিক শক্ত হয়ে দাঁড়াতে পারেনি আমাদের সমাজ। যে বয়সে ছেলেমেয়েরা মহাকাশযান চড়ে গ্রহান্তরে পাড়ি দেয়ার স্বপ্ন আঁকবে, ঠিক সেই সময়ে আমাদের তরুণরা সুবেশধারী ভণ্ডদের খপ্পরে পড়ে যৌনরোগ নিয়ে মাথা ঘামাতে গিয়ে নিজের দৈহ্যিক ও মানসিক উভয় সৃজনশীলতাকেই পায়ে মাড়িয়ে জাতির ভবিষ্যতকে শপে দিচ্ছে কুসংস্কারের আস্তাকুঁড়ে।

এটা ঠিক, বিজ্ঞানের অগ্রগতির সাথে সাথে আমাদের সমাজের অনেক কুসংস্কারই বিদায় নিয়েছে বা নেয়ার পথে। কিন্তু যৌন-সমস্যার ক্ষেত্রে সমাজ বিংশ শতাব্দীর শুরুতেও যেখানে ছিল আজও পড়ে আছে সেই তিমিরেই। এর কারণ, ভণ্ডচিকিৎসকেরা বিজ্ঞানের সুফলকে কাজে লাগিয়ে নিজেদের স্বার্থ চরিতার্থ করছে। বিশেষ করে, স্বার্থ হাসিলের মাধ্যম হিসেবে পত্রিকা আর টেলিভিশনকে লাগাতে পেরেছে সুচারুভাবে।

আমাদের সমাজে সবচেয়ে বড় কুসংস্কার যৌনতা নিয়ে। আরো নির্দিষ্ট করে বললে—হস্তমৈথুন ও স্বপ্নদোষ নিয়ে। এগুলো শুরু হয় বয়োসন্ধিক্ষণে, শেষ হয় না কখনো। ছেলেদের ক্ষেত্রে বয়োসন্ধিক্ষণের শুরু ১৩-১৪ বছর বয়সে, মেয়েদের ক্ষেত্রে দু-এক বছর এদিক ওদিক হতে পারে। এসময় হঠাৎ করেই ছেলেমেয়েদের শারীরিক গঠনের দ্রুত পরিবর্তন ঘটতে শুরু করে। পরিবর্তন আসে যৌন-সংশ্লিষ্ট বিশেষ অঙ্গগুলোতেও। সেই সাথে আগমন ঘটে যৌন অনুভূতির। মেয়েরা ঋতুপ্রাপ্ত হয়, ছেলেরা হয় বীর্যবান। কিন্তু হঠাৎ শরীরের পরিবর্তন বেশ জোরালো প্রভাব ফেলে কিশোর-কিশোরীদের মনে। নানা-রকম জিজ্ঞাসা, চিন্তা আচ্ছন্ন করে করে তোলে তাদের মনকে। কিন্তু প্রশ্নগুলির উত্তর দেবে কে? বাবা? তিনি ভীষণ রাশভারী মানুষ। তবে কি মা? ছিঃ ছিঃ কী লজ্জা, তাঁর কাছে এসব জিজ্ঞেস করা যায়! তাহলে কি চাচা-চাচি, খালা, মামা? উহু, এসব কথা মুখে আনতেই লজ্জা, তো জিজ্ঞেস করবে কি! দাদা-দাদি কিংবা নানা-নানিকে অবশ্য অনেকে জিজ্ঞেস করতে পারে। কিন্তু তাদের কাছে সঠিক উত্তরটা যে পাওয়া যাবে তার গ্যারান্টিই বা কে দেবে? বন্ধু-বান্ধবিকে জিজ্ঞেস করা যেতে পারে। কিন্তু একই সমস্যা তো তাদেরও।
তাহলে উপায়?
উপায় বাতলাতে পারে হাটের হকার, গাঁয়ের কবিরাজ কিংবা রাস্তার মোড়ে ‘কামসূত্র’ জাতীয় যেসব চটি বই পাওয়া যায় সেগুলো। সুতারাং এরাই ভরসা।

কিন্তু কী শেখায় এরা? একটা তালিকা করে ফেলতে পারি—

১. সাত ফোঁটা (মতান্তরে ৭০ ফোঁটা) রক্ত থেকে এক ফোঁটা বীর্য তৈরি। তাই বীর্যের অপচয় মানে রক্তের অপচয়।

২. যেহেতু হস্তমৈথুন আর বা স্বপ্নদোষের ফলে বীর্যের অপচয় হয়, তাই এতে যারা অভ্যস্ত তারা অচিরেই রক্তস্বল্পতায় ভুগবে।

৩. যারা হস্তমৈথুনে অভ্যস্ত বা স্বপ্নদোষে আক্রান্ত তাদের মুখোমণ্ডল ভেঙে যায়, চোখ গর্তে বসে যায়, চোখের নিচে কালি পড়ে।

৪. হস্তমৈথুন চালিয়ে গেলে বা স্বপ্ন দোষ বন্ধ না হলে, ভবিষ্যতে কিছু কঠিন রোগের আক্রান্ত হবার সম্ভাবনা ১০০%। যেমন, গণোরিয়া, সিলিফিস, যৌনাঙ্গে পাথর, ডায়াবেটিস, ধ্বজভঙ্গ ইত্যাদি। এগুলো থেকে ভবিষ্যতে আরো দুটি ভয়ঙ্কর রোগের নিশ্চয়তা ভণ্ডরা দেবে। কিডনি বিকল ও যৌনাঙ্গে ক্যান্সার। আর ফলফল ১০০% অকাল মৃত্যু!

৫. হকাররা মুখে বলবে যৌনরোগের শেষ পরিণতি কিডনি বিকল হয়ে যাওয়া রোগিদের শতকরা ১০০ জনই অকাল মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করবে, কিন্তু উদাহরণ দেয়ার সময় সারা দেশেরে সব হকার শুধু একটা নামই বলবে। চিত্র-নায়ক জাফর ইকবাল।

পাঠক, চিত্র-নায়ক জাফর ইকবাল কিডনি বিকল হয়ে মরেছিলেন বটে। আজ থেকে বছর বছর বিশেক আগে। কিন্তু তার মৃত্যুর কারণ হস্তমৈথুন বা স্বপ্নদোষ ছিল না, তা ধ্রুব তারার মতো সত্যি। আসলে অতি জনপ্রিয়তায় বুঁদ হওয়া মানুষদের কেউ কেউ সে জনপ্রিয়তা হজম করতে পারেন না। অনিয়ন্ত্রিত উশৃঙ্খল জীবন-যাপনে অভ্যস্ত হয়ে পড়েন। জাফর ইকবালের মৃত্যর কারণও জনপ্রিয়তা। তখনকার পত্রিকাগুলোর কোনো কপি উদ্ধার করতে পারলে আমার কথার সত্যতা মিলবে।

সাতফোঁটা রক্ত থেকে একফোঁটা বীর্য তৈরি হয়—এ তথ্যটা একদম ভুঁয়া। বীর্যের উৎসস্থল অণ্ডকোষ। ব্রেন থেকে একধরনের হরমন নিঃসরণ হয় অণ্ডকোষে। সেই হরমন থেকেই বীর্যকণার সৃষ্টি। আর ওই হরমন তৈরি হয় শরীরের আর সব উপাদান যা দিয়ে তৈরি অর্থাৎ খাদ্য ও পানি দিয়ে। রক্ত শুধু সেই হরমনকে মস্তিষ্ক থেকে অণ্ডকোষে চালান করতে পারে, বীর্য তৈরি করে না।

বয়োসন্ধিক্ষণের পরে শরীরে আর সব উপাদানের মতোই নিয়মিত বীর্যরস তৈরি হয়। স্বাভাবিকভাবেই যৌনানুভূতি প্রবল হতে শুরু করে। কিন্তু সামাজিক আর ধর্মীয় অনুশাসন তো ছেলেমেয়েদের অবাধ যৌনমিলন অনুমোদন করে না। তাহলে কোথায় যাবে বীর্যথলি বা অণ্ডকোষে জমা হওয়া বীর্যকণাগুলো? নিশ্চয় সেগুলো এমনি এমনি শরীর থেকে লোপাট হয়ে যাবে না। অনবরত জমা হতে থাকলে অণ্ডকোষের ধারণ ক্ষমাতাও ফুরিয়ে যাবে একসময়। ফলে তখন আরো তীব্র হবে যৌনানুভূতি। তখন হয় তাকে হস্তমৈথুন করে বের করতে হবে, নয়তো রাত্রে ঘুমের ঘোরে স্বপ্নদোষের মাধ্যম্যে বেরিয়ে যাবে। আর যারা বেশি দুর্ভাগা, যাদের স্বপ্নদোষ হয় না নিয়মিত; হকার, কবিরাজ পরামর্শে বা সামজিক অনুশাসনের ভয়ে যারা হস্তমৈথুনে অপারগ, তাদের বীর্যপাতের একটাই রাস্তা—কোনো সুখানুভূতি ছাড়াই প্রসাবের সাথে বীর্য বেরিয়ে আসা। হকার-কবিরাজরা তখন এর গালভরা নাম দেয় ‘ধাতুভাঙা রোগ’।
এ নাকি ভয়ঙ্কর এক রোগ। যারা একবার আক্রান্ত হয় তাদের জীবন থেকে নাকি চিরতরে নির্বাসিত হয় যৌনসুখ। তার ভবিষ্যত দাম্পত্য জীবনও স্থায়ী হওয়ার সম্ভবনা ০%!
কী অদ্ভুত আবিষ্কার! একবার ভাবুন তো, ধর্ম-সমাজ, কুচিকিৎসার ভয়ে আপনি হস্তমৈথুন করবেন না, স্বপ্ন দোষ যাতে না হয় সেজন্য তাবিজ-কবচ নেবেন, পানিপড়া খাবেন আবার প্রস্রাবের সাথে বীর্য নির্গত হলেও তাকে ‘মহারোগ’ আখ্যায়িত করবেন—তাহলে বেচারা বীর্যকণাগুলো যাবে কোথায়?

আগেই বলেছি ১৩-১৪ বছর বয়সে শরীরে দ্রুত বৃদ্ধি ঘটে। বিশেষ করে উচ্চতা। তাই এই সময় স্বাভাবিক খাবার পর্যাপ্ত খেলেও শরীরের অন্যান্য বৃদ্ধিগুলো উচ্চতা বৃদ্ধির সাথে সাথে তাল মিলিয়ে চলতে পারে না। তাই ওই সময়টাতে ছেলেমেয়ের কিছুটা রোগাটে হয়ে যায়। এতে ভয় না পেয়ে, খাদ্যগ্রহণটা পর্যাপ্তভাবে চালিয়ে গেলেই আর কোনো টেনশন করার দরকার নেই। আর চোখমুখ বসে যাওয়া কিংবা চোখের নিচে কালি পড়া হলো অনিদ্রা আর দুশ্চিন্তার মিলিত ফল। সামাজিক কিংবা ধর্মীয় অনুশাসনের জন্যই হস্তমৈথুনের পর একটা অপরাধবোধ কাজ করে বয়োসন্ধিক্ষণের ছেলেমেয়েদের। একদিকে তীব্র যৌনানুভূতির কারণে তারা হস্তমৈথুনকে ছাড়তেও পারছে না, অন্যদিকে এটাকে অপরাধ বা ভবিষ্যতে যৌনরোগের আমন্ত্রক মনে করে দুশ্চিন্তায় রাতের ঘুম হারাম করছে। হস্তমৈথুনকে জীবনের আর দশটা স্বাভাবিক কাজ মনে করলেই এই শারীরিক ক্ষতিটা কিন্তু এড়ানো যায়।

ডাক্তাররা রোগ নির্ণয় করতে রোগিকে যেমন প্রশ্ন করেন, তেমনি কিছু প্যাথলজিকাল টেস্টের শরণাপন্ন হন। কিন্তু হকার-কবিরাজের কাছে প্যাথলজিকাল যন্ত্র দূরে থাক, পেটে বিদ্যেই নেই! তাই কিছু ছকবাঁধা প্রশ্নের আশ্রয় নেয় তারা। এখন আমরা চোখ বুলিয়ে নিতে পারি কী সেই প্রশ্নগুলো :

১. আপনি কি বর্তমানে হস্তমৈথুনে অভ্যস্থ? অথবা আগে কখনো অভ্যস্থ ছিলেন?

২. বসে থাকা অবস্থা থেকে হঠাৎ উঠে দাঁড়ালে কি চোখে অন্ধকার দেখেন, মাথা ঝিম ঝিম করে?

৩. দিনে কি তিন বারের বেশি প্রস্রাব হয়?

৪. প্রস্রাবে কি জ্বালা-পড়া আছে? বা কখনো ছিল? অথবা মাঝে মাঝে জ্বালাপোড়া করে?

৫. নির্গত হওয়ার সময় প্রস্রাব কি দুই ধারায় পড়ে?

৬. প্রসাবের শেষ দিকে এসে কি শরীরে ঝাঁকুনি দেয়?

৭. প্রস্রাবের শেষ দিকে এসে কি প্রসাব ফোঁটায় ফোঁটায় পড়ে?

৮. পানি দেখলে কিংবা পানিতে নামলে কি প্রস্রাবের বেগ আসে?

৯. আপনার বীর্য কি অতি তরল?

কিশোর ও তরুণ পাঠক একবার বুকে হাত দিয়ে বলুন তো, প্রশ্নগুলোর উত্তর আপনি কী দেবেন? আমার ধারণা যদি ভুল না হয় অধিকাংশই এই নয়টি প্রশ্নের একই উত্তর দেবেন। সেটা হলো, ‘হ্যাঁ।’
হকার কবিরাজরা কিন্তু আপনার ‘হ্যাঁ’ শুনে একেবারে আকাশ থেকে পড়ার ভাণ করবে। মুখোমণ্ডলে আতংকের রেখা ফুটিয়ে বলবে, ‘বলেন কি মশায়? নির্ঘাত আপনার মুত্রনালীতে পাথর হয়েছে। ছোট্ট ছোট্ট পাথর।’
এরপর সে যুক্তি দেখিয়ে বলবে, মুত্রনালীতে পাথর আটকে আছে বলেই প্রসাব দুই ধারায় বের হয় এবং শেষ দিকে এসে ফোঁটায় ফোঁটায় পড়ে।
রোগি যুক্তি শুনে ভাববেন, ঠিকই তো! কিন্তু হকারের যুক্তিতে মুগ্ধ রোগি একবারও ভাববেন না, এই যুক্তিতে না হয় প্রসাবের দুই ধারা কিংবা প্রসাব ফোঁটায় ফোঁটায় পড়ার ব্যাখ্যা পাওয়া গেল। বাকি প্রশ্নগুলোর পেছনের কারণগুলো কী? হকার তার কথার মারপ্যাঁচে, নানা গল্প শুনিয়ে প্রসঙ্গ এমন দিকে নিয়ে যায় রোগির তখন অতশত ভাবার অবকাশ থাকে না। মজমা থেকে হকারের ওষুধ নিয়ে তবে বাড়ি ফেরেন।

এখন আমরা প্রশ্নগুলোর ব্যাখ্যা করা যায় কিনা দেখতে পারি :

প্রথমেই আসা যাক বসা থেকে উঠে দাঁড়ানোর ব্যাপারটায়। মানুষ যখন এক ভঙ্গিতে বসে থাকে, তখন শরীর ও মনের একটা স্থিরতা আসে। সেই অবস্থা থেকে হঠাৎ যখন উঠে দাঁড়ায় তখন সেই স্থিরতায় ব্যাঘাত ঘটে। ফলে ব্রেন ও মনের বোঝাপড়ায় সাময়িক ব্যাঘাত সৃষ্টি হয়। ফলে নিউরণে তালগোল পাঁকিয়ে যায়। এ ব্যাপারাটা অনেকটা থেমে থাকা বাসে বসে থাকা যাত্রীদের মতো। থেমে থাকা বাস হঠাৎ চলতে শুরু করলে যেমন যাত্রীরা ভারসাম্য হারিয়ে পেছনের দিকে হেলে পড়ে, এখানেও শরীর-মনের ভারসাম্যে ব্যাঘাতের কারণে মাথা ঝিম ঝিম করে, চোখে সাময়িক অন্ধকার দেখা বা সর্ষেফুল দেখার মতো ঘটনা ঘটে।

এরপর হলো, দিনে আপনি কতবার প্রসাব করবেন? আপনার যদি ডায়েবেটিস না থাকে, তবে দিনে তিনবারের বেশি কেন, বহুবার প্রস্রাব করলেও তেমন সমস্যা হওয়ার কথা নয়। আসলে ডায়েবেটিস ছাড়া আরো কয়েকটা কারণে ঘন ঘন প্রস্রাব হতে পারে। যেমন শরীর চড়া হওয়া, পানি বেশি খাওয়া বা কম খাওয়া। বেশি পানি খেয়ে যদি বেশি প্রস্রাব হয় তাতে ক্ষতির তো কিছু দেখি না। আবার পানি কম খেলেও ঘন ঘন প্রস্রাব হয়। কথাটা অদ্ভুত শোনালেও কিন্তু সত্য। আপনি কয়েকদিন যদি পানি কম খান তো খেয়াল করবেন, আপনার প্রস্রব হলুদ হলুদ হবে, প্রস্রাব একবারে অনেক পরিমাণে নির্গত না হয়ে বারে বারে প্রস্রাবের বেগ পাবে এবং প্রস্রাবে জ্বালাপোড়া করবে। এক্ষেত্রে একটু বেশি পানি খেলেই সমস্যার সমাধান!

পুরুষের যৌনাঙ্গের ছিদ্রটা নলের মতো গোল নয়, বরং চ্যাপ্টা। তাই যৌনাঙ্গের ছিদ্রটামুখটাও চ্যাপ্টা ধরনের। যখন যৌননালী বেয়ে প্রস্রাব নির্গত হয়, তখন নালীটা ফাঁকা এবং গোলাকার হয়ে যায়। স্বাভাবিক অবস্থায় মুত্রনালীর মুখ অনেকটা ঠোঁটের মতো। অন্যসময় ঠোঁট দুটোর অগ্রভাগ পরস্পরের সাথে লেগে থাকে। লেগে থাকা অংশের দুই পাশে দুটো আলাদা ছিদ্রের মতো দেখা যায়। প্রস্রাব নির্গমনের গতি যখন কম থাকে, তখন শুধু ওই দুই ছিদ্র দিয়ে নির্গত হয়। তাই মনে হয়, দুই ধারায় প্রস্রাব পড়ছে। কিন্তু প্রস্রাবের গতি যখন বেশি থাকে তখন যৌনাঙ্গের ঠোঁট দুটো পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। ফলে তাদের দুই পাশের ছিদ্রও তখন এক হয়ে যায়। অতএব ভয় পাবার কিছু নেই। প্রস্রাবের শুরু ও শেষের দিকেই প্রস্রাবের গতি কম থাকে, তাই দুই ধারায় পড়ে।

প্রস্রাবের সময় শরীরের ভেতর ঝাঁকুনি দেয়ার কারণটা আমার অজানা। তবে তরুণ পাঠকদের অভয় দিয়ে বলতে পারি এটাও শরীরের খুবই সাধারণ একটা প্রক্রিয়া, এতে ভয় পাবার কিছু নেই।
প্রস্রাবের শেষ দিকে এসে ফোঁটায় ফোঁটায় মুত্র নির্গত হয়—এটাও খুব স্বাভাবিক ব্যাপার। যে কোনো পাত্রে পানি বা কোনো তরল পদার্থ রেখে পাত্রের নিচে একটা ফুঁটো করে দিন। কী দেখছেন? পানি যখন বেশি থাকে তখন ফুটো দিয়ে প্রচণ্ড ধারায় পানি নিচে পড়ে। কিন্তু যখন পাত্রে পানি একেবারে শেষ পর্যায়ে এসে পড়ে, তখন কিন্তু আর ধারা ধাকে না, পানি ফোঁটায় ফোঁটায় পড়তে থাকে। এর কারণ, পাত্রে যখন পানি বেশি থাকে তখন পাত্রে পানির ঘনত্ব খালি অবস্থার ঘনত্বের চেয়ে অনেক বেশি। তাই পাত্রের ভেতরে চাপটাও বেশি থাকে। তখন পানি দ্রুত ধারায় নির্গত হয়। কিন্তু যখন পানি প্রায় শেষ হয়ে যায়, তখন পাত্রের খালি জায়গাটা বাতাসে ভরে যায়। কে না জানে, বাতাসের ঘনত্ব পানির চেয়ে বহু কম! তখন পাত্রের অভ্যন্তরীণ চাপ যায় কমে। তাই পানির শেষ বিন্দুগুলোর আর অঝর ধারায় পড়ার তাগিদ থাকে না। ফোঁটায় ফোঁটায় পড়ে। আমাদের মুত্রথলিও তরল আধার বৈ তো কিছু নয়!
পরিবেশের চেয়ে তুলনামূলক ঠাণ্ড পানিতে অনেকেরই প্রস্রাবের বেগ আসে। এটা আসলে স্নায়ুবিক বিষয়। ঠাণ্ডা পানির সংস্পর্শে এলে আমাদের শরীরের নার্ভ সিস্টেমগুলো অনেকটা ঢিলা হয়ে যায়। ফলে মূত্র থলি থেকে মুত্র মুত্রনালীর অনেকটা কাছাকাছি চলে আসে। আর মুত্র মুত্রনালীর কাছাকাছি আসা মানেই প্রস্রাবের বেগ অনুভূত হওয়া। অনেকের শরীর একটু বেশি সেনসেটিভ। তাঁরা যখন ঠাণ্ডা পনিতে নামার কথা ভাবেন, তখনই মস্তিষ্ক একটা শিরশিরে অনুভূতির খবর পেয়ে যায়। ফলে পানিতে নামার আগেই শিথিল হয়ে পড়ে স্নায়ুকোষগুলো। সুতারাং প্রসাবের বেগ অনুভূত হয়। তাই এটা নিয়েও আতঙ্কিত হবার কিছু নেই।

বীর্যতারল্যও শরীরের জন্য বড় হুমকি নয়। একটটানা কয়েকদিন স্বপ্নদোষ বা অতিরিক্ত হস্তমৈথুনের ফলে স্বাভাবিক বীর্য উৎপাদন ব্যহত হতে পারে। তখন সাময়িক বীর্যতারল্য অস্বাভাবিক কোনো ব্যাপার নয়। তাছাড়া পর্যাপ্ত পানির অভাবে বীর্য তারল্য দেখা দিতে পারে। তাই বীর্য তারল্যে আতঙ্কিত না হয়ে একটু বেশি পানি খেলে কিংবা হস্তমৈথুন কয়েকদিন বন্ধ রাখলে বীর্য আবার স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসবে।

তারপরও সাবধানের মার নেই। যৌন বিষয়ক কোনো সমস্যা যদি দীর্ঘদিন ধরে চলতে থাকে তখন অবহেলা না করে একজন যৌনরোগ বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিলেই খুব সহজ্যে রোগমুক্ত হওয়া যায়। তবে ভুল করেও কেউ কবিরাজ, হকারের পাল্লায় পড়বেন না। তারা প্রথমে আপনার মগজ ধোলায় করবে। তারপর কোনোরকম ফার্মাসি জ্ঞানহীন লোকের হাতে বানানো পচা শিকড়-বাকল কিংবা ভায়াগ্রা জাতীয় ট্যাবলেট খাইয়ে বরং আপনার কিডনিটাকে চিরতরে বিকল করার ব্যবস্থা করবে। আর বিপুল অঙ্কের আর্থিক ক্ষতির কথা না-ই-বা বললাম।

লেখাটা ম্যাগাজিনে প্রকাশ হওয়ার পর অনেকেই প্রশ্ন তুলেছিলেন, আদৌ কি হস্তমৈথুনের কোনো কু’প্রভাব নেই?
এ প্রশ্নের জবাবটা শ্রদ্ধেয় বিদ্যুৎ মিত্র তাঁর ‘যৌন বিষয়ে সাধারণ জ্ঞান’ বইয়ে লিখেছিলেন– বেশি কাজ করা যেমন ভাল নয়, ভাল নয় বেশি পড়াশোনা কারাও, তেমনি বেশি হস্তমৈথুন করাও ঠিক নয়।
বেশি বেশি হস্ত মৈথুন করলে বেশ কিছু সমস্যার মুখোমুখি হতে পারে। যেমন, যেহেতু বীর্য তৈরি হয় অন্ডকোষে, তাই বেশি হস্তমৈথুনের ফলে, অণ্ডকোষে বীর্যরস তৈরিতে ব্যাঘাত ঘটতে পারে। বাড়তি বীর্য তৈরির চাপ সামলাতে হিমশিম খেতে পারে অণ্ডেকোষ। ফলে অণ্ডথলিতে ব্যাথা হওয়া অস্বাভাবিক নয়। তাছাড়া মস্তিষ্কে বীর্য তৈরির হরমোনের ঘাটতিও দেখা দিতে পারে। সেক্ষেত্রে মস্তিষ্কের ওপর বাড়তি চাপ পড়ে। ফলে মাথাব্যাথা সহ মস্তিষ্কের নানা সাময়িক ত্রুটি দেখা দিতে পারে।
তাছাড়া অতিরিক্ত হস্তমৈথুনের ফলে যৌনাঙ্গে ব্যাথা ও আংশিক বিকৃতি ঘটতে পারে।
শরীর চড়া অবস্থায় হস্তমৈথুন করলে, প্রসাবে জালাপোড়া বেড়ে যায় খুব বেশিমাত্রায়। তাই হস্তমৈথুন নিয়ন্ত্রিত ও সতর্কতার সাথে করা উচিত।

আরো কিছু প্রশ্ন এসেছে। কেউ কেউ বলছেন, হস্তমৈথুন কি করতেই হবে? কেন করতে হবে?
আমাদের দেশের নাতিশিতোষ্ণ আবহাওয়া মানুষের যৌনস্পৃহার বাড়ানোর জন্য সহায়ক। তাই বিশ্বের যেকোনো অঞ্চলের তুলনায় ভারতীয় উপমহাদেশে জনসংখ্যার ঘনত্বটা সবচেয়ে বেশি। এদেশের ছেলেমেয়েরা অতি অল্পবয়সে যৌনতাপ্রাপ্ত হয়। কিন্তু এ যুগে ১২-১৩ বছরের ছেলেমেয়েদের বিয়ের কথা কি ভাবা যায়? আর ভাবলেই বা কি, অত ছোট ছেলেমেয়ের বিয়ে দিলে শারিরিক, মানসিক, সামজিক–সবদিকেই ক্ষতি। অতএব যৌনতাপ্রাপ্ত এসব ছেলেমেয়েরা খুব সহজেই হস্তমৈথুনের দিকে ঝুঁকবে–এটা আর আশ্চর্য কী!

আরও কিছু কারণ আছে হস্তমৈথুনের। পর্নোগ্রাফিতে সয়লাব হয়ে গেছে আজকের বিনোদন বাজার। আমাদের উপমহাদেশীয় বিনোদোন ক্ষেত্রগুলোও গা ভাসিয়ে দিয়েছে পশ্চিমা সাংস্কৃতির করাল স্রোতে। নারীদেহকে পণ্য করেই তৈরি হচ্ছে বিনোদনের নানা উপাদান। সুতরাং অবিবাহিত তরুণরা হস্তমৈথুন করে নিজেদের নিবৃত করছে যৌনাপরাধ থেকে।

আরো একটা প্রশ্ন এসেছে, হস্তমৈথেুন কি করতেই হবে? না করলে কি ক্ষতি আছে?
উত্তর হলো, বাধ্যবাধকতা নেই। না করলেও কোনও ক্ষতি নেই। শুধু যে প্রতিক্রিয়টা হবে সেটাকে ভয় না পেলেই হলো। প্রতিক্রিয়ার কথা আগেই বলেছি, আবারও বলছি, হস্তমৈথুন না করলে স্বপ্নদোষ পারে, প্রস্রাবে সাথে বীর্য নির্গত হতে পারে। এগুলো বড় কোনো সমস্যা নয়। এগুলো মেনে নিয়ে কেউ যদি হস্তমৈথুন না করে তাতে ক্ষতির তো কিছু দেখি না!