তালাক অত্যন্ত স্পর্শকাতর একটি বিষয়। কেউ এই ক্ষমতার অপব্যবহার করলে কিংবা ভুল পন্থায় তা প্রয়োগ করলে সে একদিকে যেমন গুনাহগার হবে অন্যদিকে তালাকও কার্যকর হয়ে যাবে। তাই প্রতিটি বিবেচক স্বামীর দায়িত্ব হল, তালাকের শব্দ কিংবা এর সমার্থক কোনো শব্দ মুখে উচ্চারণ করা থেকে সতর্কতার সাথে বিরত থাকা।

যেকোনো উপায়ে তিন তালাক দেওয়া হলে তিন তালাক কার্যকর হয়ে বৈবাহিক সম্পর্ক সম্পূর্ণরূপে শেষ হয়ে যায়। এ অবস্থায় শুধু মৌখিকভাবে স্ত্রীকে ফিরিয়ে আনার যেমন কোনো সুযোগ থাকে না তেমনি নতুন করে বিবাহ দোহরানোর মাধ্যমেও ফিরিয়ে নেওয়ার পথ খোলা থাকে না। একাধিক সহীহ হাদীসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তিন তালাক দেওয়াকে তিন তালাকই গণ্য করেছেন। যদিও এভাবে তালাক দেওয়ার কারণে অত্যন্ত রাগান্বিত হয়েছেন।

যেমন-
মাহমুদ বিন লাবীদ রা.বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে জানানো হলো যে, জনৈক ব্যক্তি তার স্ত্রীকে একসাথে তিন তালাক দিয়েছে। তিনি (একথা শুনে) রাগান্বিত হয়ে দাঁড়িয়ে বললেন, তোমাদের মাঝে আমি থাকাবস্থায় আল্লাহর কিতাবের সাথে উপহাস করা হচ্ছে? এ সময় এক ব্যক্তি দাঁড়িয়ে বললেন, হে আল্লাহ্র রাসূল! আমি কি তাকে কতল করবো না? (-সুনানে নাসায়ী: ২/৯৮, আলজাওহারুন নাকী: ৭/৩৩৩, প্রকাশক: দারুল ফিকর)

লক্ষ্য করুন, এখানে নবীজী এক সঙ্গে তিন তালাক দেয়ার কারণে রাগান্বিত হয়েছেন, কিন্তু তাকে অকৃতকারয কিংবা এক তালাক বলে ঘোষণা দেন নি।

হযরত আয়েশা রা. থেকে বর্ণিত, রাফায়ার স্ত্রী বলল, হে আল্লাহর রাসুল, আমার স্বামী রাফায়া আমাকে এক সাথে তিন তালাক দিয়েছে? এরপর আমি আব্দুর রাহমানের সাথে বিবাহ করেছি। এখন রাফায়ার কাছে যেতে পারবো কিনা? নবীজী বললেন, আবদুর রহমান তোমার সাথে সহবাস করলে এরপর রাফায়ার নিকট যেতে পারবে।( সহীহ বুখারী ৫২৬১)

লক্ষ করুন, সাহাবাগণ জানতেন এক সাথে তিন তালাক দিলে তিন তালাক ই হয়, তাই রাফায়ার স্ত্রী তিণ তালাকের পর অন্যত্র বিবাহ বসেছেন, এরপর নবীজীর নিকট পরবরতী বিষয় জানতে এসেছেন।

সাহাবী উয়াইমির আজলানী রা. সম্পর্কে বর্ণিত হয়েছে যে, তিনি এবং তার স্ত্রী রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সামনে লিআন করলেন। যখন লিআন শেষ হলো তখন উয়াইমির রা. বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! এখন যদি আমি তাকে আমার কাছে রাখি তাহলে আমি মিথ্যাবাদী। অতঃপর উয়াইমির রা. রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সামনে স্ত্রীকে এক সঙ্গে তিন তালাক দিলেন। হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তা কার্যকর করলেন এবং তাদের মাঝে বিচ্ছেদ ঘটালেন। (-সহীহ বুখারী: হাদীস নং ৫৩০৯, সুনানে আবু দাউদ: হাদীস নং ২২৫০)

হযরত আলী রা. এর শাহাদাতের পর যখন হাসান রা. খলীফা নির্বাচিত হলেন তখন তার স্ত্রী আয়েশা খাছআমিয়া তাকে মোবারকবাদ জানান। হযরত হাসান রা. স্ত্রীকে বললেন, তোমার এই মোবারকবাদ কি হযরত আলী রা.এর শাহাদাতের কারণে? তুমি কি এতে খুশি প্রকাশ করছো? তোমাকে তিন তালাক দিলাম। যখন তার ইদ্দত শেষ হয়ে গেল তখন হাসান রা. তার অবশিষ্ট মহর এবং সাথে আরো অতিরিক্ত দশ হাজার দিরহাম পাঠিয়ে দিলেন। আয়েশা খাছআমিয়ার হাতে যখন এগুলো পৌঁছলো তখন তিনি বললেন, ‘প্রিয়ের বিচ্ছেদের তুলনায় এ সম্পদ অতি তুচ্ছ।’ হযরত হাসান রা. যখন এ কথা শুনলেন তখন অশ্রুসিক্ত নয়নে বললেন, ‘আমি যদি নানাজানকে বলতে না শুনতাম কিংবা বলেছেন, আমার আব্বার মাধ্যমে নানাজানের এ কথা না শুনতাম, ‘ যে ব্যক্তি স্ত্রীকে হায়েয থেকে পবিত্র অবস্থায় পর্যায়ক্রমে তিন তালাক দিল কিংবা একসাথে তিন তালাক দিল তার জন্য ওই স্ত্রী হালাল হবে না অন্য পুরুষের বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়া ছাড়া, তাহলে আমি তাকে ফিরিয়ে আনতাম।’ (-আসসুনানুল কুবরা: ৭/৩৩৬, আলমু’জামুল কাবীর, তাবারানী : হাদীস নং ২৭৫৭, মাজমাউয যাওয়ায়েদ : হাদীস নং ৭৭৮৮)

হযরত হারুন ইবনে আনতারা তার পিতা থেকে বর্ণনা করেন, তার পিতা বলেছেন, আমি একদিন আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. এর নিকট বসা ছিলাম। ইতিমধ্যে এক লোক এসে বলল, সে তার স্ত্রীকে এক বারেই একশো তালাক দিয়েছে। সে জানতে চাইল, এতে কি এক তালাক গণ্য হবে নাকি তিন তালাক গণ্য হবে? আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. বললেন, তিন তালাক কার্যকর হয়ে তোমার স্ত্রী তোমার থেকে সম্পূর্ণরূপে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। আর বাকি সাতানব্বই তালাকের গুনাহ তোমার উপর বর্তাবে। (-মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা: আছার নং ১৮১০১)

উপরোক্ত হাদীস ও আসার থেকে বিষয়টি সুপ্রমাণিত যে. এক সাথে তিন তালাক দিলে তা তিন তালাকই হবে । এক তালাক নয়।

সৌদি আরবের সর্বোচ্চ উলামা পরিষদ ‘হাইয়াতু কিবারিল উলামা’-এর সর্বসম্মতিক্রম সিদ্ধান্তও এটিই যে, এক সাথে তিন তালাক দিলে তিন তালাকই কার্যকর হবে, এক নয়। হুকুমতে সৌদিয়া এ সিদ্ধান্ত অনুযায়ী একটি শাহী ফরমানও জারী করেছে। যেন ওই ভুল প্রোপাগান্ডার শিকার কেউ না হয়। সেখানকার সকল আদালতে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে এই পরিষদের সিদ্ধান্তই ‘অথরিটি’।