পান্তা-ইলিশের ভ্রান্ত রীতি !!!
বাংলা নববর্ষে কম বেশি সবাই ইলিশের এক পদ করেন। বিশেষজ্ঞরা জানান ইলিশ খাওয়ার এই রীতি আমাদের হাজার বছরের ঐতিহ্য তো নই, উপরন্তু এই অর্বাচীন প্রথা আমাদের ইলিশ সম্পদের ধ্বংসের কারণ।
বাংলা বর্ষবরণ বাংলাদেশের একটি সার্বজনীন উৎসব। নতুন বছরের প্রথম দিন সবাই যার যার সাধ্যমতো উৎযাপনের মাধ্যমে দিনটি পালন করেন। বর্ষবরণ যে কয়টি জিনিস এখন অত্যাবশ্যকীয় হয়ে দাঁড়িয়েছে তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে পান্তা ইলিশ বা ইলিশ মাছ খাওয়া।
‘ঐতিহ্য অন্বেষণ’ জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণার সংস্থা। এর সহকারী ব্যবস্থাপনা পরিচালক শারমিন রেজওয়ানা পহেলা বৈশাখে ইলিশ যোগ হওয়ার বিষয়টি বিশ্লেষণ করেন।
কোথা থেকে এল পান্তা-ইলিশ?
কালের পরিক্রমণে অনেক সংস্কৃতির গ্রহণ বর্জনে আমাদের মূল সংস্কৃতির কিছুটা পরিবর্তন হয়েছে অবশ্যই! তবে পান্তা ইলিশ আমাদের আদি আদর্শ বাঙালি খাদ্যাভ্যাসে ছিল এমন রীতি কোথাও পাওয়া যায় না।
ইতিহাসের জন্ম থেকে যে দেশের প্রথম ও প্রধান উৎপন্ন ফসল ধান, সে দেশে প্রধান খাদ্য তাই হবে এটাই স্বাভাবিক! ভাত খাওয়ার এই অভ্যাস ও সংস্কার আদি-অস্ট্রীয় জনগোষ্ঠীর সভ্যতা ও সংস্কৃতির দান! সমাজের উচ্চবিত্ত থেকে নিম্নবিত্ত সকল স্তরের লোকের প্রাধান খাদ্য ছিল ভাত, হয়ত রান্নার পদ্ধতিতে কিছুটা তারতম্য হত!
চতুর্দশ শতকের শেষ ভাগের একটা বই, প্রাকৃত ভাষার গীতি কবিতার সংকলিত গ্রন্থ ‘প্রাকৃত পৈঙ্গল’য়ে আছে- ‘ওগগারা ভত্তা গাইক ঘিত্তা’। মানে হল, খাঁটি ঘি সহযোগে গরম ভাত!
নৈষধচরিতে ভাতের আরও বিস্তারি বর্ণনা আছে, ‘পরিবেশিত অন্ন হইতে ধুম উঠিতেছে, তাহার প্রতিটি কণা অভগ্ন, একটি হইতে আরেকটি বিচ্ছিন্ন! সে অন্ন সুসিদ্ধ, সুস্বাদু আর শুভ্রবর্ণ, সরু ও সৌরভময়!’
এসব কিছু থেকে এটা অনুমান করা যায় যে, বাঙালির রীতি ছিল গরম ফেনায়িত ভাত ঘি সহযোগে খাওয়া!
ভাতের সঙ্গে আর কী খেত?
‘ওগগারা ভত্তা রম্ভা পত্তা গাইক ঘিত্তা দুদ্ধ সজুক্তা
মোইলি মচ্ছা নালিত গচ্ছা দিজ্জই কান্তা পুনবস্তা!’
মানে হল, যে রমণী কলাপাতায় গরম ভাত, গাওয়া ঘি, মৌরলা মাঝের ঝোল, নালিতা মানে পাটশাক প্রতিদিন পরিবেশন করতে পারেন, তার স্বামী পুণ্যবান! মোট কথা ভাত সাধারণত খাওয়া হত শাক সহযোগে! নিম্নবিত্তের প্রধান খাবারই ছিল শাক!
বৃহধর্মপুরান মতে রোহিত (রুই), শফর (পুঁটি), সকুল (সোল) এবং শ্বেতবর্ণ ও আঁশ যুক্ত মাছ খাওয়া যাবে! প্রাণীজ আর উদ্ভিজ্জ তেলের বিবরণ দিতে গিয়ে জীমুতবাহন ইল্লিস (ইলিশ) এর তেলের কথা বলেছেন!
প্রাচীন কোনো গ্রন্থেই পান্তা-ইলিশ খাওয়ার কোনো নিদর্শন পাওয়া যায় না। নদী বহুল বাংলায় স্বাভাবিক ভাবেই মাছ খাদ্য তালিকায় অন্যতম জায়গা করে নিয়েছিল। তবে বাঙালির এই মৎস প্রীতি আর্য সভ্যতার সংস্কৃতি কোনোদিন সুনজরে দেখেনি! তবে বাঙালির বহুদিনের অভ্যাসের সঙ্গে ধর্মীয় বিধান সেদিন পেরে উঠতে পারেনি। তখন ভবদেব ভট্ট আর অন্যান্য শাস্ত্রকারগণ নানা রকম সুদীর্ঘ আলোচনার পরে এই সিদ্ধান্তে আসেন যে, কোনো রকম তিথি, চতুর্দশী, পর্ব ইত্যাদি ছাড়া মাছ খাওয়া চলবে!
নববর্ষ আজ আমাদের জন্য একটি পার্বণের তিথি। তবে তখন তো এটা কোনো তিথি বা পার্বণ ছিলই না।
ইলিশ খাওয়ার এই ভুঁইফোড়া রীতি তৈরি হয়েছে খুব সম্প্রতি। রমনার বর্ষ বরণ উৎসব এবং চারুকলার মঙ্গল শোভাযাত্রা জমে যাওয়ার পরে যখন এ এলাকা ঘিরে লোক সমাগম হতে থাকে। তখন কিছু অস্থায়ী মেলার সঙ্গে খাওয়ার দোকানও বসে। মাটির সানকিতে পান্তা-ইলিশ খাওয়া মূলত এইসব দোকানীদের আবিষ্কার। যা পরে খুব দ্রুত অন্যরাও গ্রহণ করে। প্রাচীন বাংলা বা বাংলা সনের সঙ্গে এই ইলিশ খাওয়ার কোনোই সম্পর্ক নেই।
শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিসারিজ বিভাগের শিক্ষক প্রফেসর ড. কাজী আহসান হাবীব জানান পহেলা বৈশাখে ইলিশ মাছ খাওয়ার এই প্রথা আমাদের দেশের ইলিশ সম্পদের জন্য শুধু ক্ষতিকরই নয়, এই প্রথা ধ্বংস করে দিতে পারে আমাদের গর্বের এই সম্পদ।
ড. হাবীব বলেন, ১৯৯৫ সালে বাংলাদেশের মৎস সম্পদ রক্ষার করার জন্য একটি আইন প্রণয়ন করা হয়। সেই আইনে বলা আছে ২৩ সেন্টিমিটার বা ১০ ইঞ্চির নিচের কোনো মাছ ধরা নিষেধ। এই আকারের ইলিশকে জাটকা মাছ বলে। ইলিশের জীবনচক্রে এই জাটকা সময়টা পার করে নভেম্বর থেকে মে মাসের মধ্যে। তাই এই সময়টা মাছ ধরা আইন করে নিষেধ করা হয়েছে।
ধরা নিষেধ হলেও ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ জাটকা মাছ ধরা হয় মার্চ থেকে মে মাসেই। এই সময় মাছগুলো ১০ ইঞ্চির কাছাকাছি হয়। বলায় বাহুল্য এটা কিছুটা হলেও পহেলা বৈশাখের প্রভাবে হয়। বাজারে এ সময়ে ইলিশ মাছের বিপুল চাহিদা থাকে এবং বেশি চাহিদা মানেই বেশি মুনাফা পাওয়ার সম্ভাবনা। অসময়ে সারাদেশ যদি এভাবে ইলিশ মাছ খাওয়ার উৎসবে মেতে ওঠে তবে মৌসুমে ইলিশ তো পাওয়া যাবেই না্ উল্টো ইলিশের সার্বিক মজুদেও প্রভাব পড়বে।
“বছরের পর বছর এটা চলতে থাকলে একটা সময় ইলিশ নামের মাছটি বিলুপ্ত হয়ে যাওয়ায় অসম্ভব নয়”, বললেন জানান ড. হাবীব।
ড. কাজী আহসান হাবীব।
তিনি আরও যোগ করেন, ২০১৩-১৪ সালের অর্থনৈতিক সমীক্ষা অনুযায়ী, বাংলাদেশের মোট মৎস সম্পদের ১১ শতাংশ আসে ইলিশ থেকে। যার মূল্যমান প্রায় ১৭ হাজার কোটি টাকা। বাংলাদেশের মোট জিডিপির ১ শতাংশ অবদান ইলিশের। প্রায় ২৫ লক্ষ মানুষের জীবিকা ইলিশ মাছকে ঘিরে। ইলিশ মাছের ধ্বংস তাই শুধু মাছটির বিলুপ্তি না, জীবিকারও বিলুপ্তি। এ সব কারণেই আইনটা মানার বিষয়ে সরকার বেশ কড়া অবস্থানে রয়েছেন। তবে এসব আইনের ফাঁক-ফোঁকর গলে শহরের বাজার, সুপার মলে দেদাছে ইলিশ মাছ বিক্রির উৎসব চলছে।
এর প্রভাব শুধু এতটুকুই নয়। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্যমতে, দেশের মূল্যস্ফীতির মান গত ৪০ মাসে প্রথম ৬ শতাংশের নিচে নেমেছে। ফেব্রুয়ারি এবং মার্চে তা ছিল ৫.৬২ ও ৫.৬৫ শতাংশ। শুধুমাত্র সবাই মিলে ইলিশ কেনার ধুমে এইমাসের মূল্যস্ফীতি আবার ৬ শতাংশের উপরে চলেও যেতে পারে।
সম্প্রতি জাতীয় অর্থনীতি পরিষদের নির্বাহী কমিটির একটি সভায় স্বয়ং পরিকল্পনা মন্ত্রী আহম মুস্তফা কামাল জানিয়েছেন, এ মাসে এভাবে ইলিশ কেনার কারণে দেশের মূল্যস্ফীতি দশমিক ০১ শতাংশ হলেও বৃদ্ধি পাবে। এটি একটা দেশের সার্বিক অর্থনীতির হিসাবে বেশ বিপদজনক পরিস্থিতি।
ইলিশ কেনা বা খাওয়ার আগে এই কথাগুলো মাথায় রাখার পরামর্শ দেন ড. হাবীব।