অবক্ষয় রোধে ধর্মীয় মূল্যবোধ !!!
পত্রিকা আর টেলিভিশনের খরব মানেই এখন ভীতির বার্তা। প্রতিদিন খুন, ধর্ষণ, শিশু নির্যাতনসহ নানাবিধ অনাচার-অবক্ষয়ের খবরই এখন ‘আলোচিত নিউজ’। এ দৃশ্য এখন নিত্যদিনের। খবরের ছবি, শিরোনাম ও স্থান-কালেরই কেবল পরিবর্তন ঘটেছে; চরিত্র ও ধরনে কোনো পরিবর্তন নেই। দু-একটি ব্যতিক্রম বাদে সবই অপরাধের খবর। দৈনিক বাংলাদেশ প্রতিদিন তাদের খবরে বলছে : নারী ও শিশু নির্যাতনের ঘটনা অতীতের যেকোনো সময়ের রেকর্ড অতিক্রম করেছে। এ ঘটনায় আমরা এখন বিপদসীমা অতিক্রম করে ফেলেছি বলে সংশ্লিষ্টরা মন্তব্য করেন। সারা দেশের নারী ও শিশু নির্যাতনের ঘটনাগুলো জনমনে উদ্বেগ তৈরি করেছে। বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের তথ্যমতে, ২০১৫ সালে ধর্ষণের শিকার হয় এক হাজার ৯২ জন নারী ও শিশু। আর ২০১৪ সালে এই সংখ্যা ছিল ৬৬৬ জন। অর্থাৎ এক বছরের ব্যবধানে ধর্ষণের ঘটনা বৃদ্ধি পেয়েছে প্রায় ৩৫ শতাংশ। বাংলাদেশ মানবাধিকার বাস্তবায়ন সংস্থার (বিএমবিএস) মতে, জানুয়ারি থেকে মার্চ—এই তিন মাসে চল্লিশের বেশি শিশুকে হত্যা করা হয়। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রাজন-রাকিব হত্যাকাণ্ডের মতো দ্রুত বিচার আইনে নারী ও শিশু নির্যাতনকারীদের শাস্তি নিশ্চিত না হলে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে না। মানবাধিকার সংস্থা ‘অধিকার’-এর মার্চ মাসে প্রকাশিত প্রতিবেদন মতে, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে মার্চ—এই তিন মাসে মোট ধর্ষণের শিকার ১৬৯ জন নারী ও শিশু। এই তিন মাসে যৌন হয়রানির শিকার হন ৭০ জন। আর এসিড সহিংসতার শিকার হন ১১ জন নারী। আইন ও সালিস কেন্দ্রের প্রতিবেদন অনুযায়ী জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি—এ দুই মাসে মোট ধর্ষণের শিকার হন ১০৫ জন নারী। এর মধ্যে গণধর্ষণের শিকার হন ২৯ জন। ধর্ষণের পর হত্যা করা হয় তিনজনকে। ধর্ষণের পর আত্মহত্যা করেন দুজন। আর ধর্ষণের শিকার হয়েছে এমন ২০ জন ভিকটিমের বয়স সাত থেকে ১২ বছর। আইন ও সালিস কেন্দ্রের একই সময়ে শিশু নির্যাতন নিয়ে তৈরি করা প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ধর্ষণের পর মৃত্যু হয়েছে দুটি শিশুর। শারীরিক নির্যাতনে একজন গৃহশ্রমিক শিশু ও পিটিয়ে হত্যা করা হয় ১৮টি শিশুকে। অপহরণের পর হত্যা করা হয় ১১টি শিশুকে। এ সময়ে ১৩ নিখোঁজ শিশুর মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়। সম্প্রতি কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজের শিক্ষার্থী সোহাগী জাহান তনু (১৯) হত্যাকাণ্ডের বিচার দাবি করে প্রতিবাদে উত্তাল হয়ে উঠেছে সারা দেশ। তাঁকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে বলে প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে। (বাংলাদেশ প্রতিদিন : ৩-৪-২০১৬ ইং) অর্থনৈতিকভাবে দেশ এগোচ্ছে। শিক্ষার হার বাড়ছে। সার্বিকভাবে জনগণের জীবনযাত্রার মানও বাড়ছে। কিন্তু সামাজিক ও পারিবারিক অঙ্গনে অশান্তি এবং অস্থিরতাও বাড়ছে সমানতালে। শিক্ষার হার বাড়ছে, কমছে সততা। আপাত ভদ্রলোক বাড়ছে, কমছে নিখাদ ভালো মানুষ। জনসংখ্যা বাড়ছে, কমছে ‘মানুষ’। আইন কঠোর হচ্ছে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যও বাড়ছে; কমছে না অপরাধপ্রবণতা। মানুষকে ‘মানুষ’ হিসেবে জ্ঞান করতে না পারলে স্বাভাবিক নিয়মেই হারিয়ে যায় মানবিক মূল্যবোধ। চলে যায় প্রেম, ভালোবাসা ও স্নেহ-মমতা। বিনষ্ট হয় শান্তি-শৃঙ্খলা। শুরু হয় মানুষের মধ্যে পারস্পরিক হানাহানি, মারামারি, কাটাকাটি। বর্তমান বিশ্বে যা হরহামেশাই ঘটছে। মানবতা ও নৈতিকতার কোনো স্তরেই নিরপরাধ মানুষের প্রাণহানি ও অহেতুক রক্তপাত সমর্থন করা হয় না। হীনস্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য, প্রতিশোধ গ্রহণের অসৎ উদ্দেশ্য সাধনের জন্য যারা নিরপরাধ মানুষকে হত্যা করে, তারা মানবতাবর্জিত ও সভ্যতার শত্রু। শান্তি, সাম্য ও মানবিক ধর্ম ইসলাম মানুষের জান-মাল রক্ষা করার জন্য সব ধরনের জুলুম, অন্যায় ও রক্তপাত নিষিদ্ধ করেছে। বিদায় হজের ভাষণে মহানবী (সা.) বলেন, ‘আজ এই পবিত্র দিনে (বিদায় হজের দিন), পবিত্র মাসে এবং পবিত্র (মক্কা) শহরে তোমাদের জন্য যেমন যুদ্ধবিগ্রহ ও অপকর্ম করা অবৈধ, তেমনিভাবে তোমাদের জান ও মাল বিনষ্ট করাও অবৈধ।’ (বুখারি : হা. ১৭৪১, মুসলিম : হা. ১৬৭৯) কোথাও কোনো হত্যাকাণ্ড ঘটতে দেখলে অন্যদের উচিত নির্যাতিত ব্যক্তির সাহায্যে এগিয়ে আসা। আল্লাহ বলেন, ‘আর যে কারো প্রাণ রক্ষা করল, সে যেন (বিশ্বের) সব মানুষের প্রাণ রক্ষা করল।’ (সুরা : মায়েদা, আয়াত : ৩২) মানুষকে বলা হয় সামাজিক জীব। সৃষ্টিগতভাবে সামাজিকতার উপাদান মানুষের মধ্যে রয়েছে। সব বিষয়ে কাউকে নিরঙ্কুশ ও সার্বভৌম ক্ষমতা দেওয়া হয়নি। পদে পদে মানুষকে পরনির্ভর ও পরমুখাপেক্ষী হতে হয়। তথাপি মানুষ সামাজিকতার উপাদানগুলো উপেক্ষা করে অসামাজিক হয়ে ওঠে। ক্ষমতার দ্বন্দ্বে, আদর্শিক লড়াইয়ে, পার্থিব দুনিয়ার মোহগ্রস্ত হয়ে মানুষ সংঘাতে লিপ্ত হয়। ইসলাম কখনোই হত্যা, নৈরাজ্য সৃষ্টি, সহিংসতা ও সন্ত্রাসকে প্রশ্রয় দেয় না। পৃথিবীতে নৈরাজ্য ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকে নিষেধ করে আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘পৃথিবীতে বিপর্যয় সৃষ্টি করতে প্রয়াসী হয়ো না। নিশ্চয়ই আল্লাহ তাআলা বিপর্যয় সৃষ্টিকারীকে পছন্দ করেন না।’ (সুরা : কাসাস, আয়াত : ৭৭) বাংলাদেশ একটি মুসলিম অধ্যুষিত দেশ। এ দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ধর্ম ইসলাম। ইসলামে কখনোই অশ্লীলতা, পৈশাচিকতা ও আদিম পশুত্বকে প্রশ্রয় দেওয়া হয়নি। বরং মানবসভ্যতার ইতিহাসে অশ্লীলতা নির্মূলে ইসলাম সর্বাধিক কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। অশ্লীল পোশাক, নৃত্য, জিনা-ব্যভিচার ও বল্গাহীন জীবনযাপন ইসলাম কঠোরভাবে নিষিদ্ধ করেছে। প্রকৃত মুসলিম সমাজব্যবস্থায় কখনোই অশ্লীলতা ও বেহায়াপনা স্থান পায়নি। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘তোমরা ব্যভিচারের কাছেও যেও না। এটা অশ্লীল ও নিকৃষ্ট আচরণ।’ (সুরা : বনি ইসরাইল, আয়াত : ৩২) নারী-পুরুষের পারস্পরিক আকর্ষণ সহজাত হলেও সামাজিক বিপর্যয় রোধে এর বিধিবদ্ধ নিয়ন্ত্রণের তাগিদ কেউ অস্বীকার করে না। এ ক্ষেত্রে ধর্মীয় অনুশাসন, বিশেষত ইসলাম ধর্মের নির্দেশনা মেনে নেওয়ার বিকল্প নেই। বিবাহবহির্ভূত অবাধ জীবনাচারের কোনো সুফল চীন, জাপান, কানাডা ও পশ্চিমারা পায়নি। সেসব দেশে বর্তমানে জনসংখ্যা সংকট দেখা দিয়েছে। প্রাপ্তবয়স্ক নারী-পুরুষের বিয়েশাদির ব্যবস্থা না করা হলে সমাজে তা নানা অপরাধ উসেক দিতে বাধ্য। সন্দেহ নেই, বাংলাদেশ ডিজিটাল যুগে পদার্পণ করেছে। এর বহু কল্যাণের পাশাপাশি কিছু অকল্যাণকর নেতিবাচক দিকও রয়েছে। ইন্টারনেট ও মোবাইল ফোনের সহজলভ্যতার কারণে পর্নো ও অশ্লীল ছবি ঘরে ঘরে ঢুকে পড়ছে। বিভিন্ন দেশে এসব পর্নো সাইট বন্ধ করা হলেও বাংলাদেশে এর বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি। ধর্মীয় মূল্যবোধের ওপর যখন জাগতিক স্বার্থ, বৈষয়িক উন্নতির চিন্তা প্রাধান্য পায়, পরকালে জবাবদিহির ভয় যখন মানুষের মধ্যে হ্রাস পায়, তখন মানুষ কেবল পাপাচারেই জড়ায় না, মানবিক বোধটুকুও হারিয়ে ফেলে। বস্তুত পরকালের ভাবনা মানুষের কুপ্রবৃত্তি নিয়ন্ত্রণ করে। মানুষের ভেতর সুপ্রবৃত্তি ও সদগুণাবলি জাগিয়ে তোলে। যার মধ্যে আল্লাহর সামনে দাঁড়ানোর ভয় কিংবা পরকালের ভাবনা কাজ করে না, তাকে আইন দিয়ে নিবৃত্ত রাখা কঠিন। তাই সামাজিক সব অপরাধ দমনে অন্য সব উদ্যোগের পাশাপাশি সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন নৈতিক মূল্যবোধ জাগ্রত করা।
লেখক : ইসলামী গবেষক